up

'দি রেপ অব নানকিং'

নানজিং চীন


দি রেপ অব নানকিং বইটি পড়ি আমি কয়েক বছর আগে।ইতিহাস সম্পর্কিত বই আমার বরাবরই পছন্দ, তা যদি হয় কোন দেশ বা স্বাধীনতা সম্পর্কিত হয় তাহলে তো কোন কথাই নেই।সেই দিক থেকে দি রেপ অব নানকিং বইটি যথার্থ।এই বই পড়ে আমি নানজিং এ জাপানী সেনাবাহিনীর লোমহর্ষক এবং লজ্জাজনক ইতিহাস জানি।তাই চীনের নানজিং এ বেড়াতে গিয়ে আমি ইতিহাসের কলঙ্কময় এই অধ্যায়ের স্মৃতি জাদুঘর 'নানজিং ম্যাসাকার'দেখতে যাই।

জাদুঘরে এই বইয়ের লেখিকা আইরিশ চ্যাঙ এর ভাস্কর্য দেখে থমকে দাঁড়াই।একজন লেখিকার লেখার এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি কি হতে পারে।এই সম্মানের বড় কারন হলো 'দি রেপ অব নানকিং' বইটি ইংরেজি ভাষার প্রথম প্রধান বইগুলির মধ্যে একটি, যা নানকিং গণহত্যাকে পশ্চিমা এবং পূর্ব পাঠকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। বইটি অনেক ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।আর বইটি এত জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে লেখিকা দেড় বছরে 65টি শহরে সফর করে তাঁর বই সংক্রান্ত সভা সমিতিতে যোগদান করতে।

'দি রেপ অব নানাকিং' বইয়ের মূল পটভূমি হলো ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বরে চীনের নানজিং এ, জাপানী সৈন্যরা এক নৃশংস,বর্বর হত্যাযজ্ঞ ঘটায়।যা ইতিহাসে নানজিং ম্যাসাকার নামে পরিচিত। মানুষের নৃশংসতার এক নগ্ন উদাহরণ এ গণহত্যা। ধর্ষণের শিকার হয় ২০ হাজার নারী। কারো কারো মতে, ধর্ষণ করা হয় দশ থেকে আশি হাজার নারী-শিশু ও কিশোরীকে। গণধর্ষণের শিকার হয় অসংখ্য নারী।'দি রেপ অব নানকিং' নামক এই ঐতিহাসিক অসাধারন বইটি লিখেছেন আইরিশ চ্যাঙ। হত্যাযজ্ঞের বেঁচে যাওয়া বা ভিকটিম পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাতকার এবং বিভিন্ন ভাষায় রচিত দলিলপত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে রচনা করেছেন এই ঐতিহাসিক দলিতসম গ্রন্থটি।


                                                       
                                                                        'দি রেপ অব নানকিং'

১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই গণহত্যা ৬ সপ্তাহব্যাপী চলে।জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনী প্রায় ৪০,০০০থেকে ৩,০০,০০০ নিরীহ চীনা জনগনকে হত্যা করে এবং ব্যাপক লুটপাট ও ধর্ষণ করে।এই নৃশংসতার বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখিকা লিখেছেন, “...নানকিংকে শুধু হত্যা করা মানুষের সংখ্যার জন্যই নয়, যে নিষ্ঠুরভাবে অনেকের মৃত্যু হয়েছে তার জন্যও স্মরণ করা উচিত; চীনা পুরুষদের বেয়নেট অনুশীলন এবং শিরচ্ছেদ প্রতিযোগিতায় ব্যবহৃত হত। আনুমানিক 20,000-80,000 চীনা নারী ধর্ষিত হয়েছিল। অনেক সৈন্য ধর্ষণের পর তাদের স্তন টুকরো টুকরো করেছিল।পিতারা তাদের মেয়েদের এবংছেলেদের তাদের মাকে ধর্ষণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল, যা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দেখতে হয়েছিল।শুধু জীবন্ত দাফন, কাস্টেশন, অঙ্গ ছেদ করা এবং আগুনে পোড়ানো নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে ওঠেনি, বরং আরও অমানবিক অত্যাচার করেছিল তারা, যেমন মানুষকে জিভ দিয়ে লোহার হুকে ঝুলিয়ে দেওয়া বা কোমর পর্যন্ত পুঁতে রেখে জার্মান শেফার্ড কুকুর দিয়ে মানুষের শরীর ছিন্ন ভিন্ন করা।'


                                                              'দি রেপ অব নানকিং'

এ গণহত্যার মূল পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তৎকালীন জাপানী সম্রাট হিরোহিতো।কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আত্মসমর্পণের শর্ত অনুসারে জাপান সম্রাট অথবা রাজপরিবারের সদস্যদের পরবর্তীতে কোন অপরাধের জন্য বিচারের সম্মুখীন করা যায় নাই।যা ভিকটিম পরিবার তথা চাইনিজদের জন্য অবর্ণনীয় কষ্টের।সেই হৃদয়ের রক্তক্ষরণের আভাষ মেলে লেখিকা আইরিশ চ্যাঙের কথায়।তিনি বইটি লেখার পেছনের কারন সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেন,

'ছোটবেলায়, চ্যাংকে তার বাবা-মা বলেছিলেন যে নানকিং গণহত্যার সময়, জাপানিরা শিশুদের শুধু অর্ধেক নয়, তৃতীয় এবংচতুর্থ অংশে কেটে ফেলেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তার বাবা-মা তাদের পরিবারের সাথে চীন থেকে তাইওয়ান এবং তারপরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গিয়েছিল।'এতে বোঝা যায় ভিকটিম পরিবার গুলো এই স্মৃতি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বহন করছে।

'দ্য রেপ অফ নানকিং বইয়ের এর ভূমিকায়, লেখিকা লিখেছিলেন যে তাঁর শৈশব জুড়ে, নানকিং গণহত্যা অবর্ণনীয় মন্দের রূপক হিসাবে মনের অভ্যন্তরে ছিল।যখন তিনি তাঁর স্কুলের এবং স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরিগুলিতে নানজিং এর এই গণহত্যা সম্পর্কিত বই খোঁজ করেছিল এই নৃশংসতা সম্পর্কে জানার জন্য, তখন কোন তথ্য বা বই পান নাই।তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন এমন ভয়াবহ বর্বরতা নিয়ে কেউ এখনো কলম ধরেনি দেখে।মানুষের নৃশংসতার এই নগ্ন গণহত্যাকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরার ইচ্ছে তখন থেকে তাঁর মাঝে জন্ম নিয়েছিল।সেই সুযোগ আসে যখন তিনি প্রযোজক শাও জুপিং ও ন্যান্সি টং এর সাথে যোগাযোগ হয়। এরপর চ্যাঙ 1994 সালের ডিসেম্বরে ক্যালিফোর্নিয়ার কুপারটিনোতে অনুষ্ঠিত নানকিং গণহত্যার উপর একটি সম্মেলনে যোগ দেয়া পর 1997 বইটি লিখে।

'দ্য রেপ অফ নানকিং' বইটি এতটাই পাঠক সমাদৃত হয় যে প্রকাশিত হওয়ার পর প্রায় অর্ধ মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছিল।বইটি 10 ​​সপ্তাহের জন্য নিউইয়র্ক টাইমসের সেরা বিক্রেতার তালিকায় ছিল এবং চার মাসে 125,000 এরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে।এই বইয়ের জনপ্রিয়তা লেখিকা আইরিস চ্যাঙকে রাতারাতি সেলিব্রিটিতে পরিণত করে।তাঁকে সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদান করা হয়।এছাড়াও দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস দ্বারা প্রফাইল; এবং রিডার্স ডাইজেস্টের প্রচ্ছদে প্রদর্শিত হয়েছিল।

লেখিকা আইরিশকে বইটি শুধু সম্মানই এনে দেয় নাই, তাঁর মৃত্যুর কারনও এই বই। বইটি প্রকাশিত হওয়া পর, চ্যাং জাপানি উগ্রবাদীদের কাছ থেকে হুমকি এবং ঘৃণামূলক মেইল ​এবং তাঁর গাড়িতেও হুমকিমূলক নোট পেয়েছিলেন।যা ধীরেধীরে তাঁর স্নায়ুরোগ রোগের কারন হয়ে দাঁড়ায়।অবশেষে তিনি 9 নভেম্বর, 2004 এ আত্মহত্যা করেছিলেন।আত্মহননের আগে তিনি লিখে ছিলেন,'as long as alive, these forces will never stop hounding me'

ক্যালিফোর্নিয়ার লস অল্টোসে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সাথে মিল রেখে নানকিং গণহত্যায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের দ্বারা চীনে একটি স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।'দ্য মেমোরিয়াল হল অফ দ্য ভিক্টিমস ইন দ্য নানজিং ম্যাসাকার'এর এই স্মারক সাইট 2005 সালে তাঁকে উৎসর্গ করা হয়েছিল।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ads Inside every post