up

# ডিজনিল্যান্ড - সাংহাই, চীন


বিশ্বজুড়ে চিত্ত বিনোদনের সবচেয়ে জনপ্রিয় থিম পার্কের তালিকায় ডিজনির জয় জয়কার।আমার জানা মতেসেরা ২৫টির মধ্যে ১২টিই তাদের।তাই চীনের সাংহাই ডিজনিল্যান্ড নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই আমার  আগ্রহ ছিল সীমাহীন।আমাদের 18 দিনের চীন ভ্রমণের শেষ তিন দিন রেখে ছিলাম সাংহাই এর জন্য।সাংহাই  গিয়েছি মূলত ডিজনিল্যান্ড দেখার জন্য। 


সাংহাই ডিজনিল্যান্ড 2016 থেকে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।মূলত ছয়টি থিমে আলাদা আলাদা এলাকা নিয়ে সাজানো হয়েছে এটি।থিম গুলো হল-অ্যাডভেঞ্চার আইল, কল্পনা উদ্যান, মিকি অ্যাভিনিউ, কালমারল্যান্ড, ট্রেজার কোভ এবং ফ্যান্ট্যাসিল্যান্ড। সাংহাই ডিজনিল্যান্ড বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ডিজনি থিম পার্ক। এখানে সব বয়সীদের ভিড় থাকে সারাবছর।

আমাদেরকে স্থানীয় এক শুভাকাঙ্ক্ষী আগেই সতর্ক করেছে অতিথিরা পার্ক খোলার কম পক্ষে 30 মিনিট আগে প্রবেশের জন্য লাইন দিয়ে থাকে,তাই খুব সকালেই বের হয়েছি।আমাদের টিকেট অগ্রিম ভিত্তিতে কেটে রেখেছিল প্রায় 10দিন আগে,সরাসরি টিকেট নিলে প্রায় 7/15 ডলার বেশী পড়ে।সাপ্তাহিক খোলা দিনের টিকিটের মূল্য থেকে জাতীয় ছুটি, সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং শিক্ষার্থীদের গ্রীষ্মের ছুটি (জুলাই এবং আগস্ট) দিনগুলোতে টিকেটের দাম বেশী থাকে।তাই মধ্যম আয়ের অনেকে খোলার দিনে আসে এখানে বেড়াতে।আমরা যখন গিয়েছি সেদিন খোলার দিন ছিল।তাতেই আমার মনে হয়েছিল প্রচণ্ড ভিড়।পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী মানুষের দেশ চীনকে বিগত পনের দিন মনে হয়নি জনবহুল দেশ, বরং মনে হয়েছে মানুষ তো খুবই কম, কোথাও ভিড় নেই। নেই মানুষের জটলা।বরং ঢাকা তার চেয়ে শতগুণ জনবহুল।তবে এখানে এসে মনে হল, হ্যাঁ চীন জনবহুল বটে।😂





পৃথিবীর অন্যান্য ডিজনিল্যান্ড থেকে সাংহাই ডিজনিল্যান্ড কিছুটা আলাদা কারণ। এটি তৈরি করা হয়েছে সম্পূর্ণ চীনা সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে।







প্রবেশ পথেই পড়বে মিকি অ্যাভিনিউ।মিকি অ্যাভিনিউটি প্রধান আকর্ষণ হল মিকি এবং অন্যান্য কার্টুন চরিত্রগুলি অতিথিদের স্বাগত জানায়।অ্যাভিনিউতে প্রবেশ করার সাথে সাথে এই সুন্দর কাটুন বন্ধুদের সাথে বাচ্চারা আনন্দ করতে শুরু করে।এভিনিউয়ের সামনে বিখ্যাত স্টিমবোট সহ মিকি ফাউন্টেনে ছবি তোলার চমৎকার ব্যবস্থা রেখেছে।বাচ্চারা আনন্দে হাততালি দিতে শুরু করেছিল, যখন মিকি স্টিমবোট চালাতে শুরু করেছে।





তারপর, ফ্যান্টাসিল্যান্ডের পিটার প্যানের উড়ন্ত জাহাজে গান শুনে আর গুপ্ত ধনের সন্ধান শেষ করে,চলে এলাম রাশিচক্রের বারটি প্রাণী নিয়ে সাজানো ফেন্টাসি গার্ডেনে।ডিজনি চাইনিজ রাশিচক্রের প্রাণী গুলিকে এত সুন্দর করে তৈরি করেছে প্রাণবন্ত মনে হয়।

ডিজনি গল্পের সমস্ত রাজকন্যারা কিন্তু থাকে ক্যাসেলে। ক্যাসেলে প্রবেশ করলেই রাজকন্যারা অতিথিদের আনন্দের সাথে গ্রহণ করে এবং এত এত ছবি তোলার পোজ দিয়েও তারা বিরক্তি নেই বিন্দু পরিমাণও। ক্যাসেলের সোনার ছাদে একটি বিশাল মুকুট স্থাপন করা হয়েছে। এটিকে রাজকন্যাদের প্রতীক মানা হয়।





আর ক্যাপ্টেন জ্যাকের জাহাজে করে বোর্ডিং এবং জলদস্যুদের সাথে যাত্রা করা এবং নৌ যুদ্ধ, সমুদ্রের দানব এবং বিশাল বিশাল ঢেউ সবই আমাদেরকে কিছু সময়ের জন্য নিয়ে গেল এডভেঞ্চার মূলক নৌভ্রমণে।

নৌভ্রমণের আনন্দ শেষ হতে না হতেই স্টোমাক বিদ্রোহ করে বসল,বাধ্য হয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে হল পরবর্তী থিম জোনে না গিয়ে।লাঞ্চ করে আমরা ঢুকলাম একটা ডিজনি সপে।ছোট-খাটো কিছু গিফট কিনবো বলে।তবে সপে ঢোকার আরেকটা উদ্দেশ হল খাবারের পর খানিকটা বিরতি নেয়া।জিনিষের দাম অবশ্য অনেক বেশী।অরজিনাল ডিজনি সপ বলে কথা,তাই দাম দিয়েও জিনিষ গুলো হাতে নিয়ে তৃপ্তির হাসি এল অজান্তে।





বিশেষত সাংহাই ডিজনিল্যান্ডের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি আমাকে অবাক করেছে এত মানুষ কিন্তু কোথাও এক বিন্দু ময়লা নেই।এত এত বাচ্চা হাঁটছে, খাচ্ছে হাত থেকে হয়তো বা পড়ছেও, কিন্তু ময়লা নেই।আরেকটা বিষয় আমি লক্ষ করেছি চীনে অন্যান্য জায়গার চেয়ে ডিজনিতে ইংরাজি ভাষার ব্যবহার বেশী, কারন বোধ হয় প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব বা বিদেশী অতিথি।কারন যাই হোক তাতে আমাদের সুবিধে হয়েছে।খাবারের অর্ডার দিতেও সুবিধে হয়েছে।চায়নার বেশীর ভাগ রেস্টুরেন্টে আমরা কি চাইছি বা কি তাদের আছে সেটা বোঝাতে দুপক্ষকেই বেশ কসরত করতে হয়।

আমাদের তারপরের অভিযান ছিল সবচেয়ে আনন্দের।পৃথিবীর বিখ্যাত সব জায়গা আর স্থাপনা ঘুরে আসার এই রাইড আমাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করলো চীনের গ্রেট ওয়াল থেকে ভারতের তাজমহল, সাহারা মরুভূমি, আফ্রিকার জঙ্গল,আটলান্টিকা মহাদেশে পেঙ্গুইনে হাঁটাহাঁটি, ইতালির পিসা টাওয়ার, ব্রাজিলের রাইস্ট দ্য রিডিমার সহ প্রতিটি ভ্রমণ পিয়াসী মানুষের সব স্বপনের জায়গা গুলোতে ঘুরিয়ে আনলো 20/25 মিনিটে।চমৎকার এই বিশ্বভ্রমণে আনন্দ নিয়ে বের হয়ে জঙ্গল ক্রুজ, হন্টেড হাউজ, রিভার রেলরোড সহ দারুণ সব রাইডে অংশ নিয়ে কখন যে সন্ধে হয়ে গেল টেরই পেলাম না।অবশ্য মাঝে মাঝে ছবি তুলতে কিন্তু একদম ভুলিনি।এই রোগে শুধু আমি একা আক্রান্ত ছিলাম না,বেশীর ভাগ মানুষই ছিল। আসলে পার্কটা এতটাই গোছানো যেকার, যে কোথাও দাঁড়িয়ে পোজ দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল।

আমার ব্যক্তিগত অভিমত হল,কেউ যদি আমাদের মতো সাধারণ ভিজিটর হন তবে এলোমেলো ভাবে হেঁটে,চলে বিশেষ বিশেষ আকর্ষণ গুলো দেখার জন্য একটি দিনই যথেষ্ট।যেমন আমরা চীন ভ্রমণের অংশ হিসাবে সাংহাই ডিজনি ল্যান্ড দেখেছি।তবে কেউ যদি সিরিয়াস ডিজনি অনুরাগী হন তবে অবশ্যই দু'দিন হাতে নিতে বলবো।কারন সিরিয়াস ডিজনি ফ্যান বিশেষ করে টিন এজেরা তো প্রতিটি সো এবং রাইডস্ উঠতে চাইবে বা প্রতিটি থিমকে তাদের পড়া রূপকথার সাথে মিলাবে ছবি তুলবে।এছাড়াও কেনাকাটা করতে, লেজার শো দেখতে এবং কেবল পার্কটি ভালো ভাবে ঘুরে দেখতে হলেও সময় দরকার। আমরা তো সময়ের সীমাবদ্ধতার কারনে অনেক রাইডস্, স্টুডিও এড়িয়েছি।বিশেষ বিশেষ আকর্ষণ গুলি তো ইতিমধ্যে দীর্ঘ লাইনের রেকড তৈরি করেছে।এমনকি কম জনপ্রিয় আকর্ষণ গুলোরও গড় ওয়েট-টাইম 30 মিনিটেরও বেশি লাগে।তবে একটা বিষয় আমার ভাল লেগেছে গুগল ম্যাপ আমাদের সময় বলে দিচ্ছিল কতক্ষণ লাগবে।তাই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়েছে, আমরা দাঁড়াবো না চলে যাবো অন্য জায়গায়।





সবশেষে আমরা গেলাম ডিজনি পার্কের অন্যতম আকর্ষণ লেজার সো দেখতে।15/20 মিনিটের মধ্যে গ্রাউন্ডটা ভরে গেল।কর্মীদের দক্ষ ব্যবস্থাপনায় কয়েক হাজার মানুষকে সুন্দর ভাবে বসিয়ে প্রায় ঘণ্টা খানেক পর শুরু হল সেই কাঙ্ক্ষিত আলোর উৎসব।ডিজনির সবকিছুতেই কল্পজগতের রূপকথার ছাপ লক্ষণীয়। লেজার সোতে শিশুদের চিন্তার রাজ্য জুড়ে থাকা মজার সেই চরিত্র গুলো আলোর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়।আমি আতস বাজির এমন চমৎকার প্রদর্শনী কখনো দেখিনি।মনে হল দীর্ঘ অপেক্ষা সার্থক, এবং লেজার সো না দেখলে মনে হয় ডিজনিল্যান্ডের আনন্দ পরিপূর্ণই হবে না।আলোর উৎসবের মাঝে এই বিদায় পর্ব আমার কাছে রাজকীয় মনে হল।যেন রূপকথার সব চরিত্র গুলো এক সাথে অতিথিদের বিদায় দিল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ads Inside every post