up

#মালদ্বীপ ভ্রমণ-হুলেমালে,মালে সিটি

 


স্বর্গের দ্বীপ মালদ্বীপের ভেলেনা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টটি একদম সাগরের তীর ঘেঁসে।কিন্তু অন্ধকার থাকায় ল্যান্ডিং এরসময় বাহিরে কিছুই দেখতে পাইনি। তাই প্রকৃতির কন্যার নীল জলে চোখ না ধাঁধাঁলেও সাগর থেকে ভেসে আসা মিষ্টি হাওয়ার ঝাপটা,অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ভ্রমণ ক্লান্তি মুহূর্তেই দূর করে দিল।
ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট আর হোটেল বুকিং এর কাগজপত্র দেখে সাধারণ কয়েকটি প্রশ্ন করেই টুরিস্টদের 30দিনের অন এ্যারাইভাল ভিসা দিয়ে দেয়।বিশেষ করে ফ্যামিলি ভিসার জন্য একসাথে সব পাসপোর্ট নিয়ে একজনকে প্রশ্ন করেই কয়েক মিনিটেই ছেড়ে দেয়। এয়ারপোর্ট ছোট হলেও, কিন্তু বেশ ব্যস্ত ও দক্ষতার সাথে দ্রুত কাজ করে। বের হয়েই পেয়ে গেলাম আমাদের হোটেলের এজেন্টকে। ব্যাগ নিয়ে এগুতেই, দেখি সামনেই সমুদ্র। জানতাম মালদ্বীপ এয়ারপোর্ট ছোট একটি দ্বীপে,তাই বলে এত ছোট জায়গায় ভাবতে পারিনি। মানুষ দেখলাম ট্রলি ঠেলে জেটির দিকে যাচ্ছে, অন্যদেশে যেমন পার্কি লটের দিকে যায়।জেটিতে ছোট-বড় অনেক স্পিড বোট, কোনটায় যাএী উঠছে কোনটা ছেড়ে যাচ্ছে। এককথায় বেশ ব্যস্ত,তবে সুশৃঙ্খল।

আমরা চলে গেলাম হুলহুমালে।এয়ারপোর্ট থেকে ১৫/২০মিনিটের রাস্তা। রাস্তার দুপাশে ছিল সমুদ্রের নীলাভ জলের রাজত্ব।তাতে চাঁদ আলো পড়ে মোহনীয় রূপ ধারণ করেছে।নাগরিক আলোয় দ্বীপটিকে গোছানো আর পরিচ্ছন্ন মনে হলো।আমাদের হোটেলটি ছিল ঠিক সাগরের উল্টো দিকে।তাই সাগরের মিষ্টি বাতাস,আর ঢেউের গর্জন যেন আমাকে কানে এসে ফিসফিসিয়ে আগমনী অভিনন্দন জানাচ্ছে।

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি মালদ্বীপের ইতিহাস ও ঐতিহ্য খুবই প্রাচীন। সংস্কৃত শব্দ দ্বীপমালা শব্দ থেকেই মালদ্বীপ নামটাএসেছে। আবার কারও কারও মতে মালদ্বীপ হচ্ছে দ্বীপরাজ্য। কারও কারও ভাষায় এটি মহল দ্বীপ। মহল অর্থ প্রাসাদ। মোটকথায় গুচ্ছ গুচ্ছ প্রবাল দ্বীপ নিয়ে এ দ্বীপ রাজ্যে।পৃথিবীর অন্যতম নয়নাভিরাম এই দেশকে বিধাতা যেন দুই হাতে কল্পনাতীতভাবে সাজিয়েছেন।এখানে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নতমানের টুনা মাছ পাওয়া যায় বলে,মালদ্বীপকে টুনা কন্যাও বলে থাকেন অনেকে। সাগর জলে বিচ্ছিন্ন একদ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপের ব্যবধান যেমন কাছে আছে তেমনি অনেক দূরেও আছে।এমনকি ১০০ কি:মি: দূরত্বেও আছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে বর্তমান ভারতবর্ষের তামিলনাড়ু এলাকার আদিবাসী দ্রাবিড় সম্প্রদায়ের মৎসজীবি লোকেরা মালদ্বীপে প্রথম বসতি স্থাপন করেন।এখনো এদেশের আয়ের প্রধান উৎস সামুদ্রিক মাছ।সাথে টুরিজম যোগ হয়েছে।প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষের এই দেশে শিক্ষিতের হার ৯৮%।এর পেছনের কারনও হলো টুরিজম।এদেশের নতুন প্রজন্মের পেশা মূলত টুরিস্ট রিলেটেড। 





সকালের জগিং আমার ভালোলাগা , নেশা ও অভ্যাস। স্থান পরিবর্তনে কিংবা বেড়াতে গেলেও এর ব্যতিক্রম ঘটে না। তবে কোন নতুন শহরে গেলে দৌঁড়ের সাথে যোগ হয় ছবি তোলা। হুলুমালের মত চমৎকার জায়গায় এসে সূর্যাদয় দেখবো না, তা তো হতেপারে না।





রাতে গাড়ীতে আসতে মনে হলো দ্বীপটা ছোট।তবে সকালের এক চক্করে শেষ হয়ে যাবে, তা ভাবিনি।সকালে স্থানীয়দের চেয়ে বিদেশী পর্যটক বেশী নজরে পড়লো,এবং স্মার্ট পোশাকে।কেউ তাকাচ্ছেও না।যদিও এখানকার নারীরা ইসলামী কায়দায় পোশাক পরে।কিন্তু আমাদের দেশে বিদেশী নারীরা রমনাপার্কে হাঁটতে এলে গায়ে উড়না জড়াতে বাধ্য হয়,আমাদের ফালতু দৃষ্টিভঙ্গীর কারনে।সকাল শুধু মানুষকে নয়, পাখিদের মনকেও আন্দোলিত করে বলে আমি জানি। তাই তারা ভোর থেকে কিচিরমিচির শুরু করে।কিন্তু এখানে আমাকে অবাক করেছে । দ্বীপে যথেষ্ট গাছ আছে,মানুষও প্রকৃতির প্রতি বেশ আন্তরিক। টিয়া আর কাক ছাড়া তেমন কোন পাখির উপস্থিতি টের পাইনি।এমন কি কোন ধরনের গবাদি পশুও চোখে পড়ে না। শুধু প্যারাডাইস আইল্যান্ডে দুটো পানকৌড়ি আর একটা পোষা সারস পাখী দেখেছি। হয়তো পরিবেশের কোন বৈচিত্রগত কারণে হুলুমালে দ্বীপে এগুলির অস্তিত্ব নেই।

হাঁটার সময় হঠাৎ আদুরে গলায় মিউ মিউ ডেকে আমার পায়ে আচঁড় দিতে এলো কালো তুলতুলে বেড়াল।বিড়াল দেখলেই আমার ক্যামেরা বন্ধী করার স্বভাব,তাই আমার বিড়াল সংগ্রহ মন্দ নয়।বিড়ালটাও স্মার্ট, সে ক্যামেরা দেখে পোজ দিলো মডেলের মতো।হুলো শব্দটার সাথে বিড়াল বিড়াল গন্ধ আছে।।দ্বীপে পশু বলতে একমাত্র বেড়ালই দেখেছি। তাই দ্বীপটির এইনামকরণ হয়েছে কিনা, আমার সন্দেহ।তবে আপাতত নামের মিলের দিকটাই আমার কাছে বেশ লাগছে।



হঠাৎ রাস্তায় ছোট্ট ঘরের মতো একটি 'বুক ভ্যানে' আমার চোখ আটকে গেল এবং চরম বিস্মৃত করেছে। কারন এখানে বেশীরভাগ ভ্রাম্যমাণ মানুষ বা ট্যুরিষ্ট। এদের জন্য বই রাস্তায় খোলা ভ্যানে রাখা বা ফেরত নেয়ার মতো জটিল কাজ তারা কিভাবে করছে,এই ভেবে।পরে আমাদের হোটেল কর্মীর কাছে জানলাম এখানের বেশীর ভাগ বইগুলো দান করা।উদ্যোগটা নগরকর্তৃপক্ষের।সব বই গুলোই ইংরেজি আর পাঠক হলো মূলত টুরিস্টরা।তাদের কথা মাথায় রেখে সাজানো হয়েছে সেলফগুলো।।যেমন-অভিধান,ম্যাপ, টুরিজম সংক্রান্ত বই রাখা আছে। এখান থেকে বই নিয়ে তারা বীচের বালিতে শুয়ে, বসে বই পড়ে এবংযাওয়ার পথে ফেরত দিয়ে যায় নিজ দায়িত্বে। আমার মনে হলো, আমরা টুরিজম ম্যানেজমেন্টে অনেকটা পিছিয়ে। শুধু হোটেলের অবকাঠামো বানালেই যে টুরিস্ট আসবে, এমন ভাবনার যুগ বহু পেছন রয়ে গেছে।এই বোধদয়ও হয়নি।





হুলুমালের রাস্তা পরিকল্পিত পরিচ্ছন্ন,নারিকেল বাগান,ঝাউগাছ দিয়ে গোছানো দ্বীপটা।মনুষ্য সৃষ্ট কোন সৌন্দর্য না থাকলেও প্রকৃতি এখানে নিজের মতো নিজেকে সাজিয়েছে।নগর জীবনের কোলাহল, চাকচিক্য থেকে এখনো মুক্ত মনে হলো।সাদা বালির সৈকতে আকাশী পানির আঁছড়ে পড়া দেখতে দেখতে হোটেলের দিকে ফেরার পথে,সাগরের পাড়ে বিমর্ষ, উদাস এক বাংলাদেশির সাথে কথা হয়। সে নারায়ণগঞ্জের।অবৈধ হওয়ায় কোথাও বের হতে পারে না,ভয়ে ভয়ে থাকে।আমাদের দেশের সাথে মালদ্বীপের শ্রমিক চুক্তি না থাকায় প্রবাসী বাংলাদেশীরা অনেক সমস্যায় পড়তে হয় এবং ভারতীয়, শ্রীলংকানদের থেকে কম বেতন পান।এশিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রবাসীদের মতো এখানকার শ্রমিকদেরও দুর্তাবাসের বিপক্ষে হাজার অভিযোগ। এখানে প্রায় ৭০/৮০লক্ষ বাংলাদেশী কাজ করে বৈধ অবৈধ মিলিয়ে, জানালো কাদির।এখানে বাংলাদেশী শ্রমিকেরা অন্য দেশের শ্রমিকদের তুলনায় সম্মান এবং সুনামের সাথে কাজ করে।জেনে ভাল লাগলো আমার, কারন এর আগে মালয়েশিয়ান এক ভদ্র মহিলা বাংলাদেশীদের নিয়ে যে নোংরা কথা বলেছিল, তা আমি এখনো ভুলনি।অবশ্য সেটার জন্য দায়ী বাংলাদেশি পাসপোর্ট ধারী রোহিঙ্গারা।

সকালের ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা বহুলাকাঙ্ক্ষিত স্বর্গ দ্বীপ প্যারাডাইস আইল্যান্ড রিসোর্টে যাওয়ার জন্য এয়ারপোর্টে চলে গেলাম।সে এক স্বর্গ দেখার অনুভূতি।

মানবসৃষ্ট হেভেন থেকে ফেরার পথে বোটের ডেকে দাঁড়িয়ে ভেবেছিলাম,সাগরের পানির এত রং বিভাজন কখনো হয়?কোথাও সবুজাভ, কোথাও গাড় নীল,আকাশী, ফিরোজা কোথাও।সাগরের নীল জলে অবগাহন শেষে তিনদিন পর হুলেমালের ফিরে আসি।







সেদিন কোরবানি ঈদ ছিল।আমাদের গাড়ী হোটেলে পৌঁছানোর আগেই বীচের পাড়ে আনন্দোৎসব দেখে নেমে পড়লাম।কাছে গিয়ে দেখি, সৈকত জুড়ে বাজছে গান। দলে দলে ভাগ হয়ে ছেলেমেয়েরা রং খেলছে।হিন্দুদের হোলি উৎসবের মতো।রং দেয়ার জন্য তারা খেলনা গান ব্যবহার করেছে।কেউ কেউ পানি খেলছে।আরেকদল বড় বড় সাউন্ড বক্সে গান চালিয়ে নাচছিল। পাতা দিয়ে বানানো একটা ঘরকে ঘিরে।নাচের স্টাইল অনেকটা আদিবাসী নৃত্যের মতো।আমার কাছে তাদের এমন নির্মল আনন্দ আমার বেশ লেগেছে।সাথে আমার মনে পড়েছে ঢাকার রাস্তা বা গলির কথা।রক্ত আর ময়লায় কি একাকারই না হয় এই দিনের ঢাকার রাস্তা।




বিকালবেলা আমাদের নাইট ফিসিং টিপ ছিল,কিন্তু গুড়িগুড়ি বৃষ্টি আর ঝড়ো বাতাস শুরু হওয়ায় রিসিপশন থেকে ট্যুর ক্যান্সেলের কথা জানিয়ে দিল।মন খারাপ হয়ে গেল নাইট ফিসিং আর সমুদ্রে বসে বিবিকিউ এর এডভেঞ্চার থেকে বঞ্চিত হলাম এই ভেবে।আমাদের হোটেল ছিল সী ভিউ, হোটেল লবিতে বসে উত্তাল সমুদ্রের গর্জন আর মাতাল হাওযা দেখে মনে হল এই আবহাওয়া যেন সমুদ্রকে ষোড়শীর তারুণ্য ফিরিছে দিয়েছে। মনে হল যা পাইনি তার দুঃখে, যা আছে তা হারানোর মানে হয় না।তাই প্রতিটি মুহূর্তই উদযাপন করা উচিৎ।এমন রোমান্টিক আবহাওয়ায় কফি সাথে না থাকলে কি হয়! ঈদের কারনে কর্মী অভাবে কফি সার্ভিস বন্ধ থাকায় পাশের একটা কফি সপে গেলাম।সেখানে টুরিস্ট ছাড়াও অনেক স্থানীয় মানুষ ছিল ঈদের কারনে।মহানগরের স্বভাবসুলভ ব্যস্ততা নেই এখানে।সমুদ্রমুখী কাফেতে বসে ধোঁয়া-ওঠা গরম কফির কাপে চুমুক দিয়ে সমুদ্রের লাবণ্য আর ব্যাপ্তি উপভোগ করতে করতে কখন যে সন্ধ্যে হল টেরই পাইনি।







আমি রাতেই ঠিক করেছিলাম,সকালে সী প্লেনের উড্ডয়ন দেখবো।হুলেমালে একটা জেটি আছে।তাই সকালের জগিং এ আজ জেটির দিকেই গেলাম।আমাদের হোটেল থেকে 12 থেকে 13 মিনিট লাগল হেঁটে যেতে।বিভিন্ন আকৃতির জলযান সাগরে ভাসতে দেখলাম। ছোট, বড়, মাঝারি, একতলা,দুইতলা,লাক্সারি জাহাজও দেখলাম।এমনকি একটা প্রিজন বোট ওএম্বুলেন্সবোটও দেখলাম।যা আমার কাছে একদম নতুন।পানি পথে এমন যানবাহন হয় জানা ছিল না।সব দেশে যেমন রাস্তায় বিভিন্ন যানবাহন থাকে, তেমনি এখানে পানিতে।কারন এদেশে মূলত সড়ক পথই নাই এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যেতে, তাই এরা সাধারণত জলযানই ব্যবহার করে।তবে যাদের নিরাপত্তা ও সময় ইস্যু থাকে তারা সী প্লেন ব্যবহার করে।এককথায় বললে ভিআইপিরা সী প্লেন ইউজ করে।তবে কিছু দূরের দ্বীপ আছে যে গুলোতে যেতে হয় সী প্লেনে,সাধারণত ইউরোপীয়ান টুরিস্টরা যায় সেখানে।সী প্লেনে অবশ্য কয়েক মিনিটের সিটি ট্যুর দেয়া যায় 100ডলারে।এতে থাকে ফটো সুট আর সিটির উপর দিয়ে একচক্কর।





ফেরিঘাটে এই সকালে মানুষ জন একদম কম।কিছু টুরিস্ট দেখলাম পিঠে ব্যাগ নিয়ে একটা ফেরিতে উঠছে।উঠা নামার ব্যবস্থাপনা সুশৃঙ্খল এবং বাহির থেকে পরিষ্কারই মনে হল।আমাদের নৌঘাট গুলোর মত হৈচৈ নেই।তবে মাঝেমধ্যে চলমান জাহাজ, স্পিডবোট হর্ন আর মাথার উপর সি-প্লেনের আওয়াজ আছে।পথেও লোকজনের সংখ্যা অত্যন্ত কম।সাধারণত টুরিস্টরা জগিং করে সাগরের পাড় ধরে।আমি আজ উল্টা দিকে এসেছি।আমার উদ্দেশ তো জগিং কম, দেখা বেশী।হোটল আর বীচ এরিয়ার উল্টা পাশে এদের রেসিডেনশিয়াল এরিয়া এবং পোর্ট।এছাড়া এদিকে মার্কেট, স্কুল সহ অন্যান্য স্থাপনাও নজরে পড়লো।ছোট্ট একটা পার্কে শরীরচর্চার কিছু ব্যবস্থাও নজরে এল।পার্কের মানুষগুলো যার যার মত ব্যস্ত।একটু সামনে এগিয়ে ঝাউগাছের ফাঁক গলে সাগরের ঢেউের উন্মাদ গতিতে প্রবালের বাঁধে আছঁড়ে পড়ার সৌন্দর্যে আমার চোখ আটকে যায়।তাই জগিং নয়, কচ্ছপ গতিতে হাঁটছি বললে ঠিক হবে।ইচ্ছে করছিল ঝাউগাছের ফাঁকে গিয়ে একটু বসে সাগরের গান শুনি, কিন্তু আমি বিদেশী,আইনগত কোন ইস্যু তৈরি হয় কি না তাই সেদিকে না গিয়ে ধীর পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাই হোটেলকে উদ্দেশ করে।

ব্রেকফাস্টের পর আমাকে জানানো হল সাব মেরিন ট্রিপটা হচ্ছে না,কারন ঈদ এবং দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য বন্ধ থাকবে।আগামী সপ্তাহে হতে পারে, যা আমার মনটা সাতসকালেই বিষন্ন করে দিলো।আমি মালদ্বীপ আসার আগ থেকেই এই একটা ওয়াটার এক্টিভিটি নিয়ে এক্সাইটেড ছিলাম, সেটাই শেষ পর্যন্ত হল না।আমাদের হুলেমালেতে একদিন বাড়তি থাকার কারনও ছিল এই সাব মেরিন ড্রাইভ।কি আর করা।ইন্দোনেশিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশেও আছে।হয়তো বা নতুন কোন দেশে সাগরতলের এই এডভেঞ্চার উপভোগ করবো।

লাঞ্চের পর রাজধানী মালে সিটি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।আমাদের প্ল্যানে মালে ছিল না, এখন অলস সময় তাই মালে যাবো ঠিক করলাম। হুলেমালে থেকে মালে সিটি যাওয়ার ব্যবস্থা দুটি। একটি ফেরিতে,অন্যটি হলো ট্যাক্সি করে যাওয়া। ট্যাক্সিতে সাধারণত ভাড়া নেয় 60 থেকে ৭৫ রুপি।যেতে সময় লাগে ১০ থেকে ১৫ মিনিট। আর ফেরিতে যাওয়া যায় মাত্র ১০ রুপিতে সময় লাগে ২০ থেকে ২৫ মিনিট। আমরা ট্যাক্সির পথই বেছে নিলাম।আমাদের হোটেল থেকে গাড়ীতে আসা যাওয়া এবং একজন গাইড সহ ঠিক করে দিলো।যাতে ঝামেলা মুক্ত ভাবে ঘুরে আসা যায়।আমি অবশ্য ফেরিতে যাওয়ার পক্ষে ছিলাম, এতে খরচও কম আবার ভিন্ন রুটে নৌভ্রমণের অভিজ্ঞতাও নেয়া যায়।কিন্তু আমার পার্টনার আয়েশি মানুষ, তাই ট্যাক্সি নিতে হল।



হুলেমালে থেকে মালে যাওয়ার পথে 'চীন-মালদ্বীপ ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ' পড়ে।আমাদের গাইড জানালো এটা এদেশের একমাত্র দুই দ্বীপের সংযোগ সেতু।চীন সরকারের অর্থায়নে এই সেতু নির্মিত।তাই এর নাম 'চীন-মালদ্বীপ ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ'।সাগরের মধ্যে দিয়ে তৈরি এই ব্রিজ ২০১৮ সালের ৩০ আগস্টে উদ্ভোধন করা হয়।

মালে হলো মালদ্বীপের রাজধানী।পৃথিবীর স্বর্গরাজ্য মালদ্বীপের সবচেয়ে জনবহুল শহর এটি। ৫.৮ বর্গকিলোমিটার দীর্ঘ এই দ্বীপে প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার মানুষ বসবাস করে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল নগরীর রেকর্ড গড়েছে।খুব ছোট এই দ্বীপটিকে কিংস আইল্যান্ডও বলা হয়।








দ্বীপটি মালদ্বীপের অন্য দ্বীপ থেকে আলাদা। এখানে নগর জীবনের চাকচিক্যের সাথে কোলাহলও যুক্ত হয়েছে।আমার কাছে মনে হলো মালদ্বীপের নির্জনতা এখানে অনুপস্থিত। তবে নারিকেল, সুপারি গাছসহ সহ অন্যান্য নানা গাছ গাছালি তে পরিপূর্ণ ছোট্ট একটি দ্বীপ মালে। এই আইল্যান্ডে পাওয়া যায় সাগরের মাঝে নগরায়নের ছোঁয়া। মালে শহরের চারদিকে চক্রাকারে পথ।সংকীর্ণ রাস্তা, গাড়ী, বাইক,স্কুটি, এলোমেলো পথচারী সব মিলিয়ে হযবরল অবস্থা মনে হল আমার।







পুরাতন প্রেসিডেন্ট প্যালেস, পার্লামেন্ট হাউজ, হুকুরু মস্ক, মালে মাছ বাজার,ইসলামিক সেন্টার,মালে জাতীয় যাদুঘর, শিশুপার্ক,গ্র্যান্ড ফ্রাইডে মসজিদ সুনামি স্মৃতিস্তম্ভ সহ হাতে গুনা কয়েকটি জনপ্রিয় স্থান। তবে প্রবাল পাথর দিয়ে নির্মিত ‘ওল্ড ফ্রাইডেমসজিদ’ বা হুকুরু মস্ক আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপত্য ভবন।আমাদের গাইড জানালো এদেশের প্রায় সব স্থাপনা কোন না কোন দেশের অর্থায়নে তৈরি।আমি তাকে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলাম, হয় তোমরা আর্থিকভাবে কিছুটা দুর্বল না হয় তোমাদের দেশ খুব কিউট, তাই সবাই ভালবেসে গিফট করে।আমার কথায় সেও হাসলো, আমিও।বললাম মজা করেছি,তোমরা যথেষ্ট স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা দেশ, আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রানীকে ভাল না বেসে কেউ পারবেই না।







এক,দেড় ঘণ্টা সময় নিয়ে চাইলে পুরো মালে সিটি পায়ে হেঁটে ঘুরে আসা সম্ভব।ঈদের পরের দিন তাই যাদুঘর বন্ধ, যাদুঘরে ঢোকার ইচ্ছে ছিল,একটি দেশের প্রাচীন নিদর্শন, ইতিহাস, ঐতিহ্য জানা যায় জাদুঘরে গেলে।সুলতান পার্কে গিয়ে মনে হল,এতটা ছোট শুরু হতেই শেষ। আমি রমনাপার্কের জগার বলেই হয়তো বা বেশী ছোট মনে হয়েছে।পার্কের কাছেই জাতীয় আর্ট গ্যালারী।১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগ্রহশালাটি নতুন হলেও শিল্পকলার সংগ্রহ মন্দ নয়।বাকী স্থাপনা গুলো বাহির থেকে দেখে চলে এলাম মালে বাজারে।এখানে অনেক বাংলাদেশীর দোকান আছে, কথা হল কয়েক জনের সাথে।এখান থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলাম সামনে।একটু খানি এগুলেই মিনিস্ট্রি অফ ডিফেন্স অ্যান্ড ন্যাশনাল সিকিউরিটি সার্ভিসেস এর সদরদপ্তর।মালে সিটির দুই তিনটে মসজিদ ছাড়া কোন স্থাপনার স্থাপত্যকলা আমাকে আকর্ষণ করেনি।এই ভবনের সামনে বিরাট একটা চত্ত্বর আছে। যেখানে হাজার হাজার কবুতর উড়ে এসে বসে, মানুষজন তাদেরকে চালসহ এটা-ওটা খাবার দেয়।জায়গাটা সাগরের পাড়ে হওয়ায় এখানে বসে সাগরের বুনো হাওয়া আর সমুদ্র শাসন করা বাঁধের উপর আছড়ে পড়া নিরবচ্ছিন্ন ঢেউের অদ্ভুত সুরে মনকে রঙিন ঘুড়ির মতো উড়িয়ে দেয়া যায়।তবে জায়গার তুলনায় মানুষ বেশী তাই মন ঘুড়ির সূতো বেশী দূর যেতে পারবে না,কেটে যাবে।কিছুক্ষণ কবুতরের খুনসুটি দেখে আর ছবি তুলে কেটে গেল।এটাই ছিল আমাদের লাষ্ট স্পর্ট।





মনে হল,দিগন্তের ক্যানভাসে এক পরিপূর্ণ অপরাহ্ণ ক্রমশই সন্ধ্যাকে আলিঙ্গন করতে আসছে।আমাদের গাইড অন্য সব সিটিট্যুর গাইডের মতো ইতিহাস বিশেষজ্ঞ, সবকিছু নিয়েই বকবক শুরু করে, যা মাঝেমাঝে বিরক্তিকর।কারন সবসময় সব কিছুর ইতিকথা শুনতে ইচ্ছে করে না, যেমন এখানে কবুতর আসার ইতিহাসের চেয়ে বাতাসের গান শুনতে ভাল লাগছিল।এই দোষ শুধু তার নয়, সব সিটি ট্যুর গাইডের যথারীতি এই সমস্যা থাকে।

সন্ধ্যায় ফেরার সময় ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজের লাইটিং আর সাগরের নীল জল মিলে মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তৈরি করেছিল।মালদ্বীপ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র এক দশমিক পাঁচ মিটার গড় উচ্চতায় অবস্থিত।তাই মালে থেকে হুলহুলমালে যাওয়ার সময় আমার মনে হয়েছিল সাগরের উপর খুব নীচু করে বানানো সেতুর উপর দিয়ে আমার যাচ্ছি।সাগরের উত্তাল ঢেউের পানি এসে রাস্তার নিরাপত্তা কার্নিশের উপর আছড়ে পড়ছে।এমন রাস্তায় অনন্তকাল ধরে গাড়ি চললেও মনে হয় ক্লান্তি স্পর্শ করবে না।হেমন্ত বাবুর সেই বিখ্যাত 'এই পথ যদি না শেষ হয়,তবে কেমন হতো...'গানটা আমার গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে করছিল।কিন্তু ড্রাইভারের দিকে চেয়ে সেই ইচ্ছে দমন করতে হল। তাই কথা না বলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে চোখের তৃষ্ণা আর হৃদয়ের উচ্ছ্বাস নিয়ে চুপচাপ উপভোগ করলাম সে আনন্দ।

রাতের খাবারের জন্য আমরা খোলা রেস্টুরেন্ট বেছে নিলাম।রেস্টুরেন্টের ভিতরেও খাওয়া যায়,আবার সৈকতের বালিতে গাছের নীচে পাতা টেবিল চেয়ারেও দেয়া হয়, টুরিস্টদের পছন্দ অনুসারে।মালদ্বীপে আমাদের শেষ ডিনার তাই সাগরের কল্লোল ধ্বনি, মৃদুমন্দ বাতাসে বসে খাওয়াই উত্তম মনে হল।

ডিনার শেষ করেও হোটেলে না ফিরে কিছুসময় সৈকত ধরে হাঁটলাম।হোটেল আর সড়ক বাতির কল্যানে নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হয়নি।দৃষ্টিসীমানার বাইরে যত দূর চোখ যায় সাগরের পানির ওপর চাঁদের আলো আর পানির তরঙ্গের রূপবৈচিত্র্য আর ঢেউয়ের মূর্ছনা হৃদয়ে এক অব্যক্ত আনন্দের হিল্লোল যেন বয়ে দিল। মনে হলো সমুদ্রের গর্জন আর বাতাস যেন তাদের নিজস্ব কণ্ঠস্বরক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন করে পর্যটকদের অশান্ত মনকে শান্ত করে,প্রাণঞ্চল্য ফিরিয়ে দেয়ার জন্য অবিরাম চেষ্টায় লিপ্ত।





পরের দিন ব্রেকফাস্ট সেরে এয়ারপোর্ট চলে এলাম,প্রকৃতির কন্যাকে বাই বলার সময় হয়ে গিয়েছিল।বিমান যখন রানওয়ে ছেড়ে উর্ধ্বমুখী,তখন নীচের দিকে তাকিয়ে ভারত মহাসাগরের আকাশী জলরাশিতে খন্ড খন্ড সবুজ দ্বীপগুলিকে আকাশ থেকে দেখতে মনে হচ্ছিল কোন বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা চিত্রকর্ম। মুগ্ধতার শুরু এখানেই হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু রাতের বেলা বিমান ল্যান্ডকরায় সেদিন এই নয়নাভিরাম রূপ আমি দেখি নাই।একদিক থেকে ভালোই হল, শেষ দৃশ্যই মানুষের স্মৃতিতে বেশী জীবন্ত থাকে।_





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ads Inside every post