up

দুবাই ভ্রমণ (প্রথম পর্ব)

 



বহু বছর থেকে আমার শখ ছিলো মরুভূমিতে সূর্যাস্ত দেখা।আর দুবাই ছিলো হলো তারজন্য উপযুক্ত স্থান।কারণ আমার কল্পনায় দুবাই মানে ধু ধু মরুভূমি, বালির উঁচু-নিচু বালিয়াড়ি বা বালির সাগর,সেই বালির সাগরে বাতাসের কারণে তৈরী হওয়া নানান আকারের লাল বালির ঢেউ,দলবদ্ধ উটের সারি, উঁচু-নিচু পাহাড়াকৃতির বালির রাজ্য দিগন্ত জোড়া।কিন্তু রাতের ফ্লাইটে দুবাইয়ে পা দিয়ে মনে হলো দুবাই মানে চোখ ধাঁধানো রঙিন আলোর বন্যা, বিলাসবহুল জীবন,রাজকীয় রাজপ্রসাদের অন্যরকম জগৎ।যেখানে শুধুই গ্ল্যামারের হাতছানি আর জীবন উপভোগের হাজারো আয়োজনে সাজানো ডালা। মধ্য রাতে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে আমার মনে হলো শহরটি গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিকতা এবং নান্দনিকতার সমন্বয়ে।তাই তো সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাতটি প্রদেশের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়, প্রধান শহর, নিরাপদ শহর ধরা হয় দুবাইকে। বিলাসবহুল জীবনযাপন, চোখ ধাঁধানো রঙিন আলোকরশ্মি, আকাশচুম্বি অট্টালিকা, বিলাসবহুল হোটেল, কৃত্রিম দ্বীপপুঞ্জসহ ব্যবসায়িক কারণে দুবাই বর্তমানে ভ্রমণপ্রিয় এবং ব্যবসায়ীদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে।

মরুভূমির বুকের এই বিলাসী শহর দুবাইয় অবকাশ যাপনের জন্য হাজারো আয়োজন আছে।তবে এখানে ভ্রমণ করা খুব ব্যয়বহুল।তাই প্রত্যেকের বাজেট বুঝে স্থান নির্বাচন করতে হয়।আমিও পাঁচ দিনের ভ্রমণে দুবাই পুরোপুরি দেখতে পারি নাই।

দুবাই শহরের প্রধান আকর্ষণ:

বুর্জ খলিফা

৮২৮ মিটার উঁচু বুর্জ খলিফা পৃথিবীর উচ্চতম বহুতল ভবন। যা একইসঙ্গে একটি সাত তারকা হোটেল, মসজিদ, বিনোদনকেন্দ্র, নাইট ক্লাব, অ্যাপার্টমেন্ট, অফিস এবং বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্যবেক্ষণ ডেক হিসেবে বিখ্যাত।১৬০ তলাবিশিষ্ট আকাশচুম্বী এ ভবনটিতে অ্যাপার্টমেন্ট এবং স্টুডিয়ো মিলিয়ে মোট বাসস্থানের সংখ্যা ৯০০টি,এতে প্রায়  ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ থাকে।তাদের উঠানামার জন্য ঘণ্টায় ৪০ মাইল গতিবেগের মোট ৫৪টি এলিভেটর আছে।পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণ গগনচুম্বী এই বহুতল ভবনটি বিস্ময়ের প্রতীক হয়ে মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে দুবাই শহরে।জুমেইরা সৈকত থেকে ২৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বুর্জ খলিফা ‘দুবাই টাওয়ার’ নামেও পরিচিত।পর্যটকদের কাছে দুবাইয়ের সবচেয়ে দর্শনীয় এবং আকর্ষণীয় এ ভবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা হলো ১২৪ তলার পর্যবেক্ষণ ডেক।এখান থেকে শুধু দুবাই নয়, আরবের একটি বড় অংশ দেখা যায়।শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি একই ভবন থাকা এখানকার মানুষ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সূর্যাস্ত সূর্যাদয় দেখে এর উচ্চতার কারণে।শুধু উচ্চতাই নয়, বুর্জ খলিফার আভিজাত্য এবং চোখ ধাঁধানো নির্মাণশৈলী পর্যটকদের বিমোহিত করে।

বুর্জ আল আরব

৩২১ মিটার লম্বা বুর্জ আল আরব বিলাসবহুল ও অত্যাধুনিক রাজকীয় হোটেল।এর অবকাঠামো দেখতে অনেকটা পাল তোলা জাহাজ বা তিমি মাছের মতো। আকাশচুম্বী এই হোটেলটি বিশ্বের চতুর্থ সুউচ্চ ভবন।এটি বিশ্বের একমাত্র বিলাসবহুল সাত তারকা হোটেলও।পাম জুমেরাহের কৃত্রিম দ্বীপে বিলাসবহুল এই হোটেলের অত্যাধুনিক রাজকীয় অন্দরসজ্জা ও দৃষ্টিনন্দন ইন্টেরিয়র ডিজাইন টুরিস্ট মুগ্ধ করে।যার প্রতিটি রুমেই রয়েছে ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের আইপ্যাড।ব্যয়বহুল এই হোটেলে থাকতে হলে গুণতে হবে ৪ হাজার ৫০০ দিরহাম। 

মিরাকল গার্ডেন

আমরা অনেকেই স্বর্গের বাগানের গল্প শুনেছি, তবে দেখেনি।সেই অলৌকিক বাগানের দেখা পাওয়া যায় দুবাইয়ের মিরাকল গার্ডেনে।150 মিলিয়নেরও বেশি ফুল ও  72,000 বর্গমিটার জায়গায় পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় এই প্রাকৃতিক ফুলের বাগান। মনোরম এই গার্ডেন বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক ফুলের বাগানে।বিভিন্ন রঙ এবং ঘ্রাণের ফুলে সাজানো স্বর্গীয় বাগানটি নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে মে পর্যন্ত খোলা থাকে।

দুবাই ফ্রেম 

দুবাইয়ের জাবিল পার্কের 150 মিটার উচ্চতা বিশাল কাঠামোটি সবচেয়ে বড় ছবির ফ্রেম হওয়ার বিশ্ব রেকর্ড করেছে।এটির টুরিস্ট আকর্ষণের বড় কারন শহরের প্যানোরামিক দৃশ্য দেখার জন্য।কাচ, রিইনফোর্সড কংক্রিট, ইস্পাত এবং অ্যালুমিনিয়ামের আলংকারিক মিশ্রণ দিয়ে ডিজাইন করা ছবির ফ্রেমের আকৃতির মতো কাঠামো থেকে শহরের 360-ডিগ্রি ভিউ পাওয়া যায়।

স্কি দুবাই

স্কি দুবাই হল মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম ইনডোর স্কি সেন্টার। মরুভূমির বুকে মরিচিকার দেখা স্বাভাবিক কিন্তু মাইনাস তাপমাত্রায় বসবাস করা পেঙ্গুইনের দেখা মেলা কত্তো অস্বাভাবিক তা আমরা সবাই জানি।২২ হাজার ৫০০ বর্গমিটারের ইনডোর স্কি লাউঞ্জ পৃথিবীর আর কোথাও নেই।ত্বক ঝলসানো রোদের মরুভূমিতে স্কি,টোবোগগানিং এবং স্নোবোর্ডিং সহ বিভিন্ন স্নো গেমের ৪০০ মিটার দীর্ঘ ব্ল্যাক রান ওয়ে বানানোর অসম্ভব কাজ সম্ভব করেছে দুবাই। বরফঘেরা এই লাউঞ্জের ভেতরে প্রবেশ করলে কিছু সময়ের জন্য হলেও মনে এন্টার্কটিকা ভ্রমণের অনুভূতি আসবে। স্কি এর উত্তেজনাপূর্ণ ও আনন্দময় মুহূর্তকে আরো আকর্ষণীয় করে পেঙ্গুইনের উপস্থিতি।এছাড়াও বাড়তি পাওয়া হলো মাইনাস ৬ ডিগ্রি তাপমাত্রায় বসে আইসক্রিম বা কফি খাওয়া।

পাম আইল্যান্ড বা পাম জুমেইরাহ 

মানবসৃষ্ট আইল্যান্ডের জন্য পাম জুমেইরাহ বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় একটি আইল্যান্ড।এই কৃত্রিম দ্বীপটি পৃথিবীর  সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টিকারী দ্বীপ।খেয়ালি আরব শেখেরা সাগরের বুকে তৈরি করেছে কৃত্রিম তিনটি দ্বীপ।যা এখন দুবাইয়ের পর্যটন শিল্পের প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। পাম জুমেইরাহ তৈরিতে কৃত্রিম কোনও ইস্পাত বা কংক্রিট ব্যবহার করা হয়নি,ব্যবহার করা হয়েছে সমুদ্রতল থেকে আনা 120 মিলিয়ন ঘনমিটার বালি।এই তিনটি দ্বীপ এমনভাবে করা হয়েছে যা ওপর থেকে দেখতে একটি পাম গাছের মতো লাগে।এখানে রয়েছে বিলাসবহুল সব হোটেল আর রিসোর্ট।এছাড়াও রয়েছে নিজস্ব আবাসিক সৈকত, অ্যাপার্টমেন্ট, সুইমিং পুল, থিম পার্ক, রেস্তোরাঁ, শপিংমল, হাসপাতাল এবং খেলাধুলার সুবিধা।টুরিস্টরা এখানে ইয়ট বা স্পিডবোটে পাম জুমেইরার চারপাশে ঘুরা যায়।এছাড়া আটলান্টিস রিসর্টের পাশ দিয়ে যাওয়া পাম মনোরেলেও ঘুরা যায়।

দুবাই অ্যাকুরিয়াম

বিশ্বের বৃহত্তম ইনডোর অ্যাকোয়ারিয়ামগুলির মধ্যে একটি ধরা হয় দুবাই অ্যাকোয়ারিয়ামকে।একটি মলের ভিতরে প্রায় 33,000 প্রজাতির জলজ প্রাণী ও 10-মিলিয়ন-লিটার ট্যাঙ্কে 400 টিরও বেশি হাঙ্গরের একটি অ্যাকুরিয়াম সত্যিই অবিশ্বাস্য।এখানে পর্যটকরা 10-মিলিয়ন-লিটার জল-ভর্তি ট্যাঙ্কে স্নরকেল করতে পারেন,পুরোপুরি না হলেও বৈচিত্র্যময় সামুদ্রিক জীবনের সাথে অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ।এটি অন্যরকম অভিজ্ঞতা।

দ্য মিউজিয়াম অফ দ্য ফিউচার

77 মিটার উচ্চতার স্টেইনলেস স্টীল দিয়ে ডিজাইন করা এবং আরবি ক্যালিগ্রাফির উদ্ধৃতি দিয়ে খোদাই করা সাততলা ফাঁপা উপবৃত্তাকার কাঠামোর একটি জাদুঘর।এটি দুবাইয়ের নতুন পর্যটক আকর্ষণ এবং বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ভবনগুলির একটি।শহরের প্রধান মহাসড়ক শেখ জায়েদ রোডে অবস্থিত এই জাদুঘরটি দর্শকদের 2071 সালের মানে  ভবিষ্যৎ অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করে। সাত তলা ভবনটিতে কোনো স্তম্ভ নেই এবং এটি একটি প্রকৌশল বিস্ময়।

আল কুদরা লেকে

দুবাই শহর থেকে বেশ কিছু দূরে আল কুদরার মরুভূমিতে প্রায় ৫ লাখ ৫০ হাজার বর্গমিটারের বিশাল কৃত্রিম এই লেকটা সাজানো হয়েছে ভালোবাসার প্রতীক দিয়ে।তাই কেউ কেউ এই লেককে লাভ লেকও বলে।মরুভূমির বুকে ভালোবাসার প্রতীকের আকারে তৈরি লেকের নীলচে সবুজ পানিতে সার্বক্ষণিক খেলা করে অসংখ্য রঙিন মাছ।তবে পাখির চোখে মানে উপর থেকেই সবচেয়ে আকর্ষণীয় দেখায় কৃত্রিম হ্রদটি।

আল বারশা পন্ড পার্ক 

লেক এবং গাছ দিয়ে সাজানো একটা পার্ক।মরুভূমির বুকে মরূদ্যানের মতো মনে হবে এই পার্ককে।শহরের উঁচু উঁচু ব্লিডিং মাঝে গাছ ও লেকের এই পার্কটি নজর কাড়ার মতো সুন্দর।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ads Inside every post