up

#দি প্যালেস রিসোর্ট এন্ড স্পা



সবুজ মখমলের চাদর জড়ানো চা বাগান আর সুশৃঙ্খল সৈনিকের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াবীথি যেন অনাদি কাল থেকে দাঁড়িয়ে আছে অতিথিকে গার্ড অফ অনার দিবে বলে।রাস্তার দুই পাশের ছোট ছোট পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চলে গেছে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা।মাঝে মাঝে দেখা যায় পিঠে টুকরি নিয়ে চা পাতা তুলছে মহিলারা।দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের এই প্রাচুর্য যেন সিলেটকে ঢেকে রেখেছে সবুজ চাঁদরে। প্রকৃতির রূপ-লাবণ্যের অপূর্ব সৌন্দর্যের ভাণ্ডার সিলেট সব সময়ই পর্যটকদের বিমোহিত করে,মানুষ খুব সহজেই প্রেমে পড়ে যায় শীতল প্রকৃতির এই লীলাভূমির।আর আমি তো রূপকথার গল্প 'ওয়ান্ডার ল্যান্ড' এর অ্যালিসের মতো দুচোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে ছুটতেই পছন্দ করি।





কয়েক মাস আগে সুযোগ পেয়ে তিনদিন দুই রাতের জন্য বেরিয়ে পড়েছিলাম নীল আকাশের নিচে সবুজ গালিচা পাতা প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে উঠা 'দি প্যালেস রিসোর্ট এন্ড স্পা' এর উদ্দেশে।হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার পুটিজুরী পাহাড়ে ৩০ হাজার গাছেঢাকা ১৫০ একর জায়গা নিয়ে টিলার চূড়ায় সব আধুনিক সুযোগ সুবিধে সহ ছায়া সুনিবিড় শান্ত নির্জন পরিবেশে ২৩টি ভিলাও একটি বহুতল ভবন সহ রাজকীয় এই রিসোর্ট।





রিসিপশনের আনুষঙ্গিকতা শেষ করে অতিথিদের গাড়ী এবং ড্রাইভার রেখে রিসোর্টের গাড়ি মানে খোলা টুকটুকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়।ড্রাইভারদের রিসোর্টের ভিতর যাওয়ার অনুমতি নেই।তাদের থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা গেটের সাথেই।ড্রাইভাররা তাই কিছুটা বিরক্ত হয়। কিন্তু এই নিয়ম অতিথিদের নিরাপত্তা এবং প্রাইভেসির জন্য।বিশেষ করে রিসোর্টের পরিবেশ উইম্যান ফেণ্ডলি রাখার জন্য। রিসোর্টের কর্মীদের এমন ভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে যে তারা অকারণে কারো দিকে চোখ তুলেও তাকায় না।আমার দেখা বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রফেশনাল বিহেভিয় করা কর্মী দি প্যালেস এর।





আমাদের নিয়ে টুকটুকটা যখন উপরে উঠছে তখন পথে দেখতে পেলাম পাহাড়ের গায়ে কৃত্রিম ঝরনা বানানো হয়েছে প্রাকৃতিক ঝরনার আদলে।মনে হবে ঝরনাধারাটি অতিথি বন্দনায় কলকল ধ্বনি তুলে চলেছে। উঁচু-নিচু টিলাঘেরা এই রিসোর্ট আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়,শুধু আয়তন না সৌন্দর্যের বিচারেও এগিয়ে রাখতে হবে।





রিসোর্টে ভিতরে গেলে প্রথমে পড়বে প্রধান টাওয়ার বহুতল ভবনটি। 'দি প্যালেস' নামকরণের সার্থকতা বোঝো যায় ভবনটির স্থাপত্যশৈলী দেখে। ১০৭টি রুম নিয়ে সাজানো প্রসাদ তুল্য এই ভবন অতিথিদের জন্য।তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে রুম গুলোকে, ভাড়া অনুসারে।





আর যারা আরো প্রাকৃতিক পরিবেশে একান্তে অবকাশ কাটাতে পছন্দ করেন তাদের জন্য হল ভিলা।ভিলা দুই ধরনের -একটা হানিমুন ভিলা, আরেকটা ফ্যামিলি ভিলা।ভিলা গুলো সাজানো হয়েছে আধুনিকতার সাথে নান্দনিকতার সমন্বয়ে।একটা ভিলা থেকে একটা ভিলার মাঝে শোভন দূরত্ব রাখা হয়েছে নিরাপত্তা আর প্রাইভেসির জন্য।আমাদের ভিলাটা ছিল লেকের পাড়েটিলার উপর একদম শেষের অংশে নিরিবিলি, শান্ত, ছায়াবৃত।দিনের বেলায়ও ঝিঁঝিঁ পোকার গান শোনা যায়।এমন নির্জনতায় মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়, নিজের সাথে কথা বলতে পারে।একান্ত নিজস্ব ভাবনা গুলো জীবন্ত হয়ে উঠে।কবি বা সাহিত্যিকের জন্য একদম উপযুক্ত জায়গা।যদিও দুটোর কোনটাই আমি নই।





রাতের একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে।আমার কাছে রাত মানে অন্ধকার নয়,রাত মানে নীরবতা,নিস্তব্দতা।রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় পাহাড় বা বনে।এই রিসোর্ট পাহাড়ে না হলেও টিলার উপর নির্জন পরিবেশে। তাই রাত এখানে মায়াজাল ছড়িয়ে দেয়।সারাদিনে ঘুমিয়ে থাকা তারারা জেগে ওঠে, নিঃসঙ্গ চাঁদকে সঙ্গ দেবার জন্য।মাঝে মাঝে অচেনা পাখীর ডাক তো আছেই।রাতের সৌন্দর্য উপভোগ থেকে বাংলাদেশের বেশীর ভাগ মেয়েরা বঞ্চিত হয় নিরাপত্তা জনিত কারনে।সেদিক থেকে আমি সৌভাগ্যবান।আমার জীবনের সেরা রাত বলতে বললে বলবো সুন্দরবনের দুইরাত আর নেম ক্যাট আইল্যান্ডের রাত।











রিসোর্টের সবচেয়ে রাজকীয় হল প্রেসিডেন্সিয়াল ভিলা।এই দুই ভিলার নামকরণে রয়েছে দেশাত্মবোধ। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের অবদানের জন্য পন্ডিত রবি শংকর ও জর্জ হ্যারিসনের নামে নামকরণ করা হয়েছে ভিলা দুইটির।





চারিদেকে শুধু সবুজ আর সবুজ।চা বাগান, আনারস বাগান, রাবার বাগান,লেবু বাগান আর পাইন ও দেবদারু গাছের সারি ছাড়াও আছে বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ এবং সবজী বাগান।সবুজের এমন হাতছানি, যেন প্রকৃতির অন্তহীন সৌন্দর্য এখানে একাকার হয়ে গেছে।এমন নৈসর্গিক প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করার জন্য আছে ২টি ট্যারেস-ফাউন্টেইন ভিউ ট্যারেস আর টি-গার্ডেন ভিউ ট্যারেস।





সকালের জগিং করার জন্য রয়েছে ৭ কিলোমিটার ট্রেইল। পুরো এলাকা জুড়ে রয়েছে সাউন্ড সিস্টেম,যার থেকে ভেসে আসে 'মেটাল মিউজিক'।তাতে অতিথিদের মনকে ক্ষণিকের জন্য হলেও নিয়ে যায় অতীতের কোন সুখকর স্মৃতিময় সময়ে।তবে আমার মতে রাতে এরা জাজ মিউজিক বাজালে আরো ভালো হতো।এতে পরিবেশ আরো মোহনীয় উঠে উঠতো।ঘণ্টা হিসেবে সাইকেল ভাড়া নেয়া যায় চালানোর জন্য, বাই-সাইকেল চালানোর জন্যও লেন রয়েছে।এছাড়া বিকালবেলা লেকে বেড়ানো যায় এবং মাছও ধরার ব্যবস্থা আছে।মজার বিষয় হল আপনার ধরা মাছ আপনাকে রান্না করে খাওয়াবে রেস্টুরেন্ট নিদিষ্ট পেমেন্টের মাধ্যমে।





একজন পর্যটক ভ্রমণের সময় প্রথমে চায় পরিবেশ, তারপর নিরাপত্তা,আরামদায়ক আবাসন, খাবার।এই রিসোর্টে এই সব আয়োজন করেছে নিখুঁত ভাবে।যত ভালো রিসোর্ট বা হোটেলই হোক,আর ভালো মানের খাবারই হোক অতিথিরা একদিনের তিন বেলায় একই রেস্টুরেন্টে বসে খেয়ে বোর ফীল করে বলে, দ্বিতীয় দিনই বাহিরে গিয়ে খেতে চায়।আর এই রিসোর্টের আশেপাশে কোন রেস্টুরেন্ট নেই,তাই অতিথিরা এখানেই খেতে বাধ্য জেনেও রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ অতিথিদের খাবারের আনন্দ দিতে 5টি রেস্টুরেন্ট তৈরি করেছে।চমৎকার সব নাম আর নান্দনিক সাজসজ্জায় সাজানো রেস্টুরেন্ট গুলো।অলিভ রেস্টুরেন্ট, রেভ্যুলেশন ক্যাফে,নস্টালজিয়া, সাইগন ও সিসা লাউঞ্জ প্রতিটি রেস্টুরেন্টই নামের সাথে মিল রেখে দৃষ্টিনন্দন অবয়ব দেয়া হয়েছে। অলিভ রেস্টুরেন্টের ভিয়েতনামি ডিস গুলো স্পেশাল।ভারতীয় মেনু গুলো পুরোপুরিভাবে ভারতীয় স্বাদ নিয়ন্ত্রণ করে।সাধারণত আমাদের দেশে বেশীরভাগ রেস্টুরেন্ট ভারতীয় বা চাইনিজ ফুড তৈরি করে বাংলাদেশী স্বাদে।আর যাদের দেশী স্ট্রিটফুডে আগ্রহ তাদের জন্য নস্টালজিয়া ক্যাফে।তবে রাতের খাবারের জন্য সাইগন সেরা আমার মতে।রেভ্যুলেশন ক্যাফের পরিবেশের তো তুলনাই হয় না।





সব রকম আধুনিক সুযোগ সুবিধে দিয়ে সাজানো হয়েছে।দি প্যালেস।এখানে রয়েছে চারটি বড় সভাকক্ষ, ৪শ’ জনের ব্যাংকুয়েট হল, ছোটদের খেলার জায়গা তিনটা, বিলিয়ার্ড, ফুটবল, বাস্কেটবল, ২টি টেনিস কোর্ট, ব্যাডমিন্টন কোর্ট, ক্রিকেট নেট প্র্যাকটিসএর সুবিধা, দুটি জিম, রিমোট কন্ট্রোল কার রেসিংয়ের ব্যবস্থা। দুটো সুইমিংপুলের একটি ইনফিনিটি পুল।আমার জানা মতে, বাংলাদেশের প্রথম ইনফিনিটি পুল। দুটো সিনেপ্লেক্স এর মধ্যে ১টি থ্রিডি ও অন্যটি টুডি।চমৎকার স্থাপত্যশৈলীর পরিচয় পাওয়াযায় দুটি ঝুলন্ত সেতুতে।এছাড়া হেলিপ্যাড তিনটাও সবুজ ঘাসের কার্পেটেও ছিল নতুনত্ব।





এককথায় রিসোর্টটির প্রতিটি ক্ষেত্রে আভিজাত্যের ছাপ পাওয়া যায়।যেন নামই নয়,কাজেও রাজকীয়।নামের যথার্থ সার্থকতা মিলে।তবে সবুজের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য পুরোপুরি ভাবে উপভোগ করতে হলে বর্ষা সেরা সময় আমার মতে।যদিও দি প্যালেস সবসময়ই গোছানো এবং যত্নে গড়া।তবুও বর্ষায় পাহাড় প্রাণ পায়, সবুজ হয়ে উঠে গাঢ সবুজ।







যান্ত্রিক জীবনের একঘেয়েমি থেকে ছুটি নিয়ে অল্প সময়ের জন্য দেশের ভিতরে আপনার পরবর্তী গন্তব্য হবার মত সব আয়োজন করে সবুজের ঢালি নিয়ে অপেক্ষা করছে রাজবাড়ী, মানে 'দি প্যালেস'।

















একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ads Inside every post