up

#কান্তজী মন্দির


 কাহিনীসমৃদ্ধ পোড়ামাটির টেরাকোটার অলঙ্করণে নির্মিত কান্তজী মন্দির স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন। ইন্দো-পারস্য স্থাপত্যধারায় নির্মিত মন্দিরটিকে আমার কাছে মনে হয় পোড়ামাটির কবিতা।

১৭০৪ সালে শুরু হয় কান্তজী মন্দির নির্মাণের কাজ। উচু বেদির উপর পোড়ামাটির ফলকে ঢাকা দেয়ালের মন্দিরের নির্মাণের কাজ কারিগরদের অসামান্য দক্ষতায় চলতে থাকে।সময়সাপেক্ষ ছিল এই আলংকারিক মন্দির নির্মাণ। ১৭২২ সালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁর পোষ্য পুত্র রামনাথ রায় সিংহাসনে বসার পর বাবার শেষ ইচ্ছা অনুসারে তিনি মন্দির নির্মাণের বাকী কাজ  ১৭৫২ সালে শেষ করেন।


প্রায় ১ মিটার উচু এবং ১৮ মিটার বাহুবিশিষ্ট বর্গকার বেদীর উপর এ মন্দির নির্মিত। ইটের তৈরী মন্দিরের প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য ১৬ মিটার ।তিন তলা এ মন্দিরের নয়টি চূড়া রয়েছে।মন্দিরে মোট নয়টি চুড়া থাকায় স্থানীয় অনেকেই নবরত্ন মন্দির নামেও ডাকেন। মন্দিরটি ১৯.২০x১৯.২০ বর্গামিটার। মন্দিরটি ১৫.৮৪x১৫.৮৪ বর্গমিটার আয়তনের একটি বর্গাকার ইমারত। প্রতিটি তলার চারপাশে বারান্দা রয়েছে।মন্দিরের পচ্শিম দিকে দ্বিতীয় বারান্দা থেকে সিঁড়ি উপরের দিকে উঠে গেছে। এর নিচ তলায় ২৪ টি, দ্বিতীয় তলায় ২০ টি এবং তৃতীয় তলায় ১২ টি দরজা রয়েছে।


পুরো মন্দিরে প্রায় ১৫,০০০ টেরাকোটা টালি আছে।উপরের দিকে তিন ধাপে উঠে গেছে মন্দিরটি।নিচতলার সব প্রবেশপথে বহু খাঁজযুক্ত খিলান আছে। ২ ইটের স্তম্ভ দিয়ে খিলানগুলো আলাদা করা হয়েছে। স্তম্ভ দুটো খুবই সুন্দর এবং সমৃদ্ধ অলংকরণযুক্ত।মন্দিরের চারদিকের সবগুলো খিলান দিয়েই ভেতরের দেবমূর্তি দেখা যায়। মন্দির প্রাঙ্গণ আয়তাকার হলেও, পাথরের ভিত্তির উপরে দাঁড়ানো ৫০ ফুট উচ্চতার মন্দিরটি বর্গাকার। মন্দিরের পশ্চিম দিকের দ্বিতীয় বারান্দা থেকে সিঁড়ি উপরের দিকে উঠে গেছে। মন্দিরের নিচতলায় ২১টি এবং দ্বিতীয় তলায় ২৭টি দরজা-খিলান রয়েছে, তবে তৃতীয় তলায় রয়েছে মাত্র ৩টি করে।


বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, কান্তজিউ মন্দির নির্মানে ব্যবহৃত পাথর আনা হয় হিমালয়, আসামের পার্বত্যাঞ্চল ও বিহারের রাজ মহল পাহার থেকে।মূলত ইট-বালি টেরাকোটা ও কঠিন পাথরের সংমিশ্রনে মন্দিরটি তৈরী করা হয়েছে।এর দেয়ালের পোড়ামাটির ফলকগুলো নিজস্বতায় অনন্য।এই পোড়ামাটির টেরাকোটায় রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী ও মুঘল আমলের বাংলার সাধারণ মানুষের জীবন ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এছাড়া এর স্তম্ভের কার্নিশে সমসায়িক জীবন ও অভিজাত শ্রেণির শিকারের দৃশ্য বিশেষ করে মুঘল বাদশাদের শিকার ও কারুকার্য খচিত রথের দৃশ্যায়ন দেখা যায়।


এককথায়,এই মন্দিরের বিশেষত্ব হলো টেরাকোটায় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, সীতার বনবাস, বাকাসুর হত্যা সহ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাহিনী সমূহ চিত্রায়িত করা হয়েছে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পৌরাণিক গল্পকথা। পৌরাণিক কাহিনীর লৌকিক উপস্থাপনে তাই কারিগরদের সৃজনশীলতা ও দক্ষতার এক অনন্য নিদর্শন এই ফলকগুলো।


নির্মাণের সময় এই মন্দিরের চূড়ার উচ্চতা ছিলো ৭০ ফুট। কিন্তু ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে এর চূড়াগুলো ভেঙে যায়। বর্তমানে এর উচ্চতা ৫০ ফুট।জমিদার মহারাজ গিরিজানাথ মন্দিরটির ব্যাপক সংস্কার করলেও শেষপর্যন্ত চূড়াগুলো সংস্কার করা সম্ভব হয়নি।এই পুরাকীর্তি রক্ষায়

১৯৬০ সালে ততকালীন সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিভাগ মন্দিরটিকে প্রাচীন কীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে এবং এর সংস্কারের দায়িত্ব নেয়।



 ঐতিহাসিক বুকানন হ্যামিলটনের মতে ‍‍‌কান্তজিউ বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দরতম মন্দির। মন্দিরটি দিনাজপুর রাজদেবোত্তর এস্টেটের একটি অংশ। দেবোত্তর এস্টেট বর্তমানে মন্দিরটি দেখাশোনা করে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মন্দিরটি দেখাশোনায় সহযোগিতা করে থাকে। এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এর সহায়তায় মন্দিরটির সামগ্রিক উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।


টেরাকোটার ফলকসমৃদ্ধ এই মন্দির ছিল অবিভক্ত বাংলার সব চেয়ে সুন্দর মন্দির। শুধু তাই নয় অবিভক্ত ভারতের এগারতম আশ্চর্যও বলা হতো এই মন্দিরকে। এই মন্দিরের গঠনশৈলী স্থাপত্যকলার যেমন অনন্য নিদর্শন, তেমনি এর জন্ম কাহিনীও বিচিত্র।জনশ্রুতি আছে, দিনাজপুরের জমিদার প্রাণনাথ রায় ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন একজন বড় কৃষ্ণভক্ত। তাই মুঘল বাদশাহ আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে রাজা উপাধি পাওয়ার পর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তিনি নিজভূমে ফিরে আসার পূর্বে বৃন্দাবনে যান এবং সিদ্ধান্ত নিলেন ফিরে গিয়ে একটি কৃষ্ণের মন্দির নির্মাণ করবেন।বৃন্দাবনের একটি মন্দিরের কৃষ্ণের বিগ্রহ তাকে বিমোহিত করে। তিনি সেই কৃষ্ণমূর্তি সঙ্গে করে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলে স্বপ্নে দেখেন, এটা করলে ভক্তরা কষ্ট পাবেন।তবে তিনি স্বপ্নে দেখেন একই রকম আরেকটা বিগ্রহ  নদীতে পারেন।তবে আরেকটা মিথ হলো প্রাণনাথ নৌবহরে আসার সময় তার বহর এক জায়গায় থেমে যায় এবং তিনি একটি কৃষ্ণমূর্তি পান।প্রকৃতপক্ষে এসব জনশ্রুতির ঐতিহাসিক বা দালিলিক কোনো ভিত্তি নেই,তবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে গুরুত্ব অনেক।


দিনাজপুর ফিরে প্রাণনাথ শ্যামগরে ঢেপা নদীর তীরে একটি অস্থায়ী মন্দির নির্মাণ করে বিগৃহের পূজার জন্য। এই অস্থায়ী মন্দিরটি এখনো কান্তজীর মন্দিরের অদূরে আছে।পরবর্তীতে ভগবান কৃষ্ণের নামানুসারে শ্যামগড়ের নাম হয় কান্তনগর।তাই এটি কান্তনগর মন্দির নামেও পরিচিত। 


পোড়ামাটির ফলক বা টেরাকোটার অনিন্দ্যসুন্দর কারুকার্যের জন্য কান্তজীর মন্দির ধর্মীয় গুরুত্বের পাশাপাশি জাতীয় ঐতিহ্যের অংশে পরিণত হয়েছে।তাই তো ২০১৭ সালের কলকাতা বইমেলায় বাংলার নিজস্ব স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন হিসাবে বাংলাদেশ সরকার তাদের প্যাভিলিয়নটি কান্তজিউ মন্দিরের আদলে গড়েন।


আশেপাশের দর্শনীয় স্থান:

কান্তজীর মন্দিরের অদূরে অবস্থিত নয়াবাদ মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী খুবই আকর্ষণীয়।ছোট্ট সুন্দর এই মসজিদের অবস্থানগত প্রাকৃতিক পরিবেশ মনোমুগ্ধকর।আরো আছে: রামসাগর, সুখসাগর, দিনাজপুর রাজবাড়ী ও শিংরা ফরেস্ট। 


কিভাবে যাবেন:

দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে কাহারোল উপজেলায় তেঁতুলিয়া মহাসড়কের পশ্চিমে কান্তজীর মন্দিরের অবস্থান। ঢাকা থেকে বাস ও ট্রেনে সরাসরি দিনাজপুর যেতে পারেন। এরপর ইজিবাইকে করে বারোমাইল নামক স্থানে নেমে এক কিলোমিটারের হাঁটা পথ পাড়ি দিলেই পৌঁছে যাবেন শান্ত ও স্নিগ্ধ প্রকৃতির কান্তনগর গ্রামে। অবশ্য বারোমাইল থেকে ভ্যানেও যেতে পারেন।আর ব্যক্তিগত গাড়ী নিয়ে গেলে তো কথাই নেই।


কোথায় থাকবেন:

দিনাজপুরে থাকার জন্য ভালো কোন হোটেল নাই।কিছু সাধারণ মানের হোটেল আছে যাতে মোটামুটি ভাবে রাত কাটানো যায়।যেমন- ডায়মন্ড, হোটেল আল রশিদ, হোটেল রেহানা, হোটেল নবীন ইত্যাদি।তবে পর্যটন মোটেল তার তুলনায় ভালো আমার মতে।এছাড়া শহর থেকে বাহিরে গেলে রামসাগরে অবস্থিত স্থানীয় বন বিভাগের বাংলো থাকার জন্য চমৎকার পরিবেশগত কারনে। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ads Inside every post