up

শার্লক হোমস জাদুঘরে কৈশোরের স্মৃতি রোমন্থন

শার্লক হোমস নামক কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্রটি ১৮৮৭ সালে প্রথম আবির্ভূত হয়।এই চরিত্রের স্রষ্টা স্কটিশ লেখক ও চিকিৎসক স্যার আর্থার কোনান ডয়েল।শার্লক হোমসের নাম শোনে নি এমন মানুষ বোধ হয় পৃথিবীতে বিরল।যখন সাহিত্যে গোয়েন্দা ধারাটি অপ্রচলিত ছিল,তখন শার্লক হোমসের সৃষ্টি।তারপর শতাধিক বছর ধরে পৃথিবীর সব গোয়েন্দা চরিত্রের অনুপ্রেরণা, সর্বকালের অন্যতম সেরা গোয়েন্দা চরিত্র হয়ে উঠে শার্লক হোমস।আমার মতো অনেকের কিশোর বয়সের হিরো।আমার তো শার্লক হোমসের নাম বলতেই ঠোঁটে পাইপ, হাতে ছড়ি, পরনে ওভারকোট, মাথায় কানটুপি পরা এই দীর্ঘদেহী-খাড়া নাকের মানুষের চেহারা কল্পনায় আসে মূহুর্তের ভিতর।অসম্ভব জনপ্রিয় এই কাল্পনিক চরিত্রটি তৈরী করেছিলেন স্যার আর্থার কোনান ডয়েল।লেখক এই কাল্পনিক চরিত্রটি তাঁর প্রাক্তন শিক্ষক, ডঃ জোসেফ বেলের ছায়া অবলম্বনে লেখেন।সেই সময়ের অপরাধ তদন্তের বিষয় এখনকার মতো আধুনিক ছিলো না।কিন্তু এই জোসেফ বেল বিভিন্ন খুনের ফরেনসিক রিপোর্ট দিয়েই খুনীর প্রোফাইল বলে দিতে পারতেন।বলা যায় তার হাত ধরেই স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড তদন্তে ফরেনসিক সাইন্স যোগ হয়, যা পরবর্তীতে সব দেশে অপরাধ তদন্তে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।লেখক এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন তার সেরা সৃষ্টি 'শার্লক হোমস' চরিত্রটি বেলের ডিডাকশনের অসাধারণ ক্ষমতাই দিয়েই তিনি তৈরি করেছেন।এবং ড. বেল ও নিজের বয়সকে মাথায় রেখে শার্লক, ওয়াটসন্, মরিয়ার্টি চরিত্র গুলো সৃষ্টি করেছেন।তবে কল্পনার এই শার্লক হয়ে ওঠে জীবন্ত,বনে যায় কিংবদন্তির চরিত্র।বিশেষ করে এডভেঞ্চার প্রিয় পাঠকদের কাছে।আমিও তাই সেই কৈশোরের ভালোবাসার টানে শার্লক হোমসের জাদুঘর ঘুরতে গিয়েছিলাম লন্ডন বেড়াতে গিয়ে।

সিটি ট্যুর বাস স্টপ থেকে পাঁচ  মিনিটের প্রযুক্তির কল্যাণে এখন আর কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয় না নতুন ঠিকানা খুঁজে পেতে।খুব সকালে যাওয়াতে বেশি মানুষ ছিল না।এটা আর দশটা জাদুঘরের মতো অবকাঠামো না, অনেকটা ছোট পরিসরে। আমি ভেতরে ঢুকে টিকেট কিনতে গিয়ে খেয়াল করলাম,এটা টিকেট কাউন্টার কাম স্যুভেনির শপ।বিভিন্ন রকমের স্যুভেনির সাজানো আছে ভক্তদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে।


কাউন্টার থেকে বের হয়ে পাশের দরজা দিয়ে মূল জাদুঘর ঢোকার পথের ট্যাডিশনাল পোশাক পরা গেট কিপারের সাথে কেউ কেউ মজা করে ছবি তুলছিল।কাল্পনিক শার্লকের বাড়ির সঙ্গে মিল রেখে এখানেও সিঁড়ি করা হয়েছে ১৭টি।প্রথমেই স্টাডি রুম। ঢুকেই বাঁ দিকে ওয়াটসনের ডেস্ক।সেখানে একটা ১৮৮১ সালের দৈনিক পত্রিকা রাখা আছে।সম্ভবত চরিত্রের সঙ্গে মিল রেখে এটা করা হয়েছে।এছাড়া ডেস্কটাতে মেডিকেলের কিছু বইও রেখেছে।তবে সব অংশ দর্শনার্থীদের জন্য খোলা নয়। কিছু অংশ আটকানো।

আরেক দিকে গেলে,সেখানে একটা ছোট টি-টেবিলের ওপর কিছু ব্যবহৃত জিনিসপত্র ছিল।আরেকটা টেবিলে মাইক্রোস্কোপটা,আতশ কাচটা আর বিখ্যাত হোমসের পাইপ।কোনায় স্তূপ করে রাখা পুরোনো পত্রিকা, বই।আমার বিখ্যাত পাইপটা ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল😊কিন্তু ধরতে মানা।এই রুম থেকে হোমসের বেডরুমে যাওয়া যায়। হোমসের বেডরুমের দেয়ালজুড়ে অনেক ছবি।আমি ভেবেছিলাম বাকী চরিত্রের অভিনেতাদের ছবি আমার ভুল ভাঙলো গাইড।সে জানাল,ছবিগুলো সব সিরিয়াল কিলার আর কুখ্যাত সব অপরাধীর ছবি।যাদের দিকে এক মিনিট আগে আনন্দের দৃষ্টিতে দেখেছি,একটু পরেই ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।যা মানুষের স্বাভাবিক স্বভাব। শার্লকের বিছানার ওপর একটা খোলা বাক্স।সেখানের  সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিসটা হলো হ্যাট।যা ছাড়া শার্লক হোমসের চেহারাই চিন্তা করা যায় না।


চারতলার এই বাড়ির প্রতিটি রুম এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যেন দর্শনার্থীরা তাদের কল্পিত চরিত্র গুলোর ভিতরে অবলীলায় প্রবেশ করতে পারে।পুরো জাদুঘরকে দর্শনার্থীদের কাছে জীবন্ত করে তুলতে উপন্যাসের আলোকে ভিক্টোরিয়া আমলের ফার্নিচার দিয়ে সাজানো হয়েছে। তিনতলার দুটো রুম ছিলো মিসেস হাডসনের চরিত্রকে প্রকাশ করার জন্য।রুমটাতে রাখা ছিল ভিক্টোরিয়া আমলের মেয়েদের পোশাক।আরেক  রুম ছিল ডা. ওয়াটসনের জন্য বরাদ্দ।সেখানটা বই আর ছবিসহ ছোটখাটো জিনিস দিয়ে সাজানো।উপরের তলার রুমে  কিছু মোমের তৈরি ম্যানিকুইন রাখা ছিল।অনেক গুলো ম্যানিকুইনের সঙ্গে প্রফেসর মারিয়ার্টিও ছিলো।


একটি কথা না বললেই নয়, আর ১০টা জাদুঘরের মতো নয় এই জাদুঘর।যে কোন জাদুঘর যেভাবে গ্যালারি করে, প্রতিটি জিনিসের নামসহ সাজানো হয়।এখানে তা করা হয় নাই।অল্প খুব কিছু জিনিসকে সেভাবে প্রথাগত ভাবে উপস্থাপন করা হলেও বেশির ভাগ নিদর্শনের সামনে কোনো ব্যাখ্যা ছিলো না।এছাড়া জাদুঘরের প্রফেশনাল গাইড যেভাবে জাদুঘরের প্রতিটি জিনিসের ব্যখ্যা দেয় দর্শনার্থীদের, সেভাবে এখানে দেয় নাই।কেউ প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়া আর প্রবেশের প্রথমে 'লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান ওয়েলকাম টু দ্য শার্লক হোমস মিউজিয়াম, আই অ্যাম হিয়ার টু হেল্প ইউ ইন দ্য জার্নি....'এছাড়া বেশি কোন দায়িত্ব পালন করতে হয় নাই।কারন জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জানেন এখানে যারা আসেন তারা তাদের কাল্পনিক চরিত্র গুলো সম্পর্কে এতবেশী জানেন যে তাদের আর নতুন করে পরিচিত করতে হবে না কিছুর সঙ্গে।


দর্শনার্থীরাও খুব একটা প্রশ্ন করে নাই তাকে, যারা এসেছে সবাই শার্লকের সব খুঁটিনাটি বিষয়ও জানে।তবে আমি কৌতূহল থেকে তাকে প্রশ্ন করেছি, কাল্পনিক চরিত্র হোমসের এসব জিনিস কোথা থেকে এল! যদিও সম্ভাব্য উত্তর জানা ছিল, শুধু মিলিয়ে নেয়া জন্য।জিনিস গুলো হলো হোমসকে নিয়ে যেসব সিনেমা, নাটক হয়েছে, সেগুলোর অভিনেতা অভিনেত্রীতের ব্যবহার করা কস্টিউমস থেকে নির্বাচন করা হয়েছে।তবে বেশির ভাগ জিনিসই সিডনি পেইজের করা চরিত্র থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।


জাদুঘর থেকে বের হয়ে ছোটখাটো স্যুভেনির কিনে রাস্তায় নেমে খেয়াল করলাম পাশের বাড়ির নাম্বার ২৩৭।সেই অনুযায়ী এই বাড়ির হোল্ডিং নাম্বার হবে ২৩৯।তার মানে কি হোমসের বাড়ির নাম্বার পরিবর্তন হয়েছে! কৌশলের দৃষ্টিতে ভালো করে দেখলাম গেটের উপর।তখন 

দোতলার জানালার নিচে 221B লেখা একটা নম্বর প্লেট ঝোলানো।ভাগ্যিস আমি গুগলে শার্লক হোমস জাদুঘর লিখে সার্চ করেছি, এড্রেস দিয়ে সার্চ করিনি।করলে হয়তো বা গোলকধাঁধায় পড়তাম।


বাস স্টপের দিকে হাঁটতে হাঁটতে কৌতূহল থেকে গুগলে সার্চ দিলাম শার্লকের বাড়ির ইতিহাস।এটি লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টারের একটি পুরানো রাস্তা।যা ১৮শ শতাব্দীদতে উইলিয়াম বেকার নামে এক ব্যাক্তি যখন  এই রাস্তা তৈরি করেন তখন ১০০ পর্যন্ত হোল্ডিং ছিল।শার্লক হোমসের উপন্যাস লেখক ইচ্ছে করে অবাস্তব একটা নাম্বার দিয়েছেন।তবে সময়ের সাথে সাথে বেকার স্টিটের নম্বর বেড়েছে।সেই হিসেবে এখন শার্লক হোমসের বাড়ির মূল নাম্বার ২৩৯।তবে ঝামেলা শুরু হলো যখন ১৯৩০ সালে সেখানে অ্যাবে ন্যাশনাল বিল্ডিং সোসাইটির অফিস শুরু হয়। অফিস চালুর পরদিন থেকে তারা চিঠি পেতে শুরু করে ২২১ বি বেকার স্ট্রিটের ঠিকানায়,শার্লক হোমসের নামে।তারা সেই চিঠির উত্তরও দিয়েছে।১৯৯০ সালে এই মিউজিয়াম যাত্রা শুরুর পর এই চিঠি নিয়ে আইনগত লড়াই শুরু হয়।শেষ পর্যন্ত ২০০৫ সালে জাদুঘরই চিঠি গুলোর মালিকানা পায়।আর ১৯৯০ সালে মূল নম্বর পালটে অফিসিয়ালি ভাবে জাদুঘরকে ২২১বি নাম্বার দেয়া।


 বাস স্টপে অপেক্ষা করতে করতে ভাবছিলাম আমাদের বাংলা সাহিত্যের একজন শার্লক হোমস আছেন 'ফেলুদা' নামের। বাংলা সাহিত্যের গর্ব সত্যজিৎ রায়ের অনবদ্য সৃষ্টি ফেলুদাকে নিয়েও একটা জাদুঘর থাকতে পারতো দুই বাংলার কোথাও।না হওয়াটা হলো আমাদের বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের দৈন্যতা।



# দরকারি তথ্য:

১. টিকিট: ১৫ পাউন্ড। 

২. খোলার সময়: ৯.৩০

৩. সিটি বাস বা মেট্রোরেল থেকে পায়ে হাঁটা পথ।

৪. লন্ডনের রাস্তার নাম্বার আমাদের দেশের মতো ক্রমানুসারে নয়, সেখানে জোড় সংখ্যা একদিকে থাকে।অন্যদিকে বিজোড় সংখ্যা থাকে।তাই।কোথাও টিকানা খোঁজ করতে বিষয়টা মাথায় রাখবেন।


 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ads Inside every post