up

# রমনাপার্ক

 


বৃক্ষলতা বিহীন এই ইট পাথরের এই শহরে রমনাপার্ককে এক টুকরো সবুজ বললে কম হবে,রমনাপার্ককে এই শহরের ফুসফুস বললে যথার্থ হয়।নামে ষড়ঋতুর বাংলাদেশ হলেও, বাস্তবতায় ঋতু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতির যে একটা রূপান্তর ঘটে, তা আমাদের নগর জীবনে কমই দৃশ্যমান হয়।আমরা কেবল দিন পঞ্জিকার পৃষ্ঠা দেখে জানতে পারি।সত্যি করে বললে বলতে হয়,আমাদের ঋতু গুলো এমন নিঃশব্দে বদল হয় যে, অতি সংবেদনশীল মানুষও কোন কোন ঋতুর উপস্থিতি টের পাওয়ার আগেই নাম বদলে যায়।তবে আমি সকালের রমনায় ঋতু পরিবর্তনের অস্তিত্ব বেশ ভালো ভাবেই উপলব্ধি করি। মাঝেমাঝে মনে হয় রমনাপার্ক না থাকলে আমার মত অনেকেরই প্রকৃতির এমন অনন্য রূপ অদেখাই থেকে যেত।

নাগরিক জীবনের ব্যস্ততম যান্ত্রিক কোলাহল থেকে মুক্তিদাত্রী চিরসবুজ এই উদ্যানটি শুধু ঋতুরঙ্গের প্রশান্তি দেয় না, এই পার্ক আমাদের  সাংস্কৃতিক- ঐতিহ্যের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে।১৯৬০-এর দশকে থেকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির নিপীড়ন ও রবীন্দ্রবিরোধীতা তথা  সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সালে ছায়ানটের  শিল্পীরা রমনাপার্কে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা করে।এই পার্ককে ছায়ানটের শিল্পীদের গানের মঞ্চ করার গল্পটাও চমৎকার।ছায়ানট যখন খোলামঞ্চে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে সরকারকে হুঁশিয়ারি বার্তা দিতে সিদ্ধান্ত নিলো, তখন স্থান নির্বাচনের দায়িত্ব পড়ল প্রকৃতি প্রেমিক ড. নওয়াজেশ আহমদের ওপর।তিনি শান্ত ও কোলাহলমুক্ত ছায়াবীথি রমনাপার্ককে অনুষ্ঠান করার জন্য নির্বাচিত করলো।সারা রাত আলো জ্বেলে ছায়ানটের কর্মীরা সেই জঙ্গল, ঘাস পরিষ্কার করে প্রথমবারের মতো বর্ষবরণের অনুষ্ঠান করে।সেদিন এখন থেকে সমবেত কণ্ঠে ছায়ানটের শিল্পীরা গেয়ে ওঠেন, ‘আলোকের এই ঝরনাধারায় ধুইয়ে দাও’।সেদিনের এই গান শুধু গান ছিল না,ছিল বাঙালী সত্ত্বাকে সংঘবদ্ধ ও উজ্জীবিত করার আহবান।সেই থেকে রমনার বটমূলের ছায়ানটের এই সুরের ধারা বাঙালী জাতির সংস্কৃতি এবং ঐক্যে, সম্প্রীতির প্রতীক হয়ে উঠেছে।তাই তো ২০০১ সালে মৌলবাদী শক্তি ছায়ানটের বর্ষবরণকে ঘিরে বাঙালি জাতিসত্তার এই আবেদন স্তব্ধ করে দিতে রমনার বটমূলে বোমা হামলা করে।কিন্তু মৌলবাদী শক্তিকে বৃদ্ধা আঙুল প্রদর্শন করে প্রতি বছরই রমনার খোলামঞ্চে এই বর্ষবরণের অনুষ্ঠান চলছে।

বাঙালী সংস্কৃতি ও ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু এই রমনাপার্কের জন্ম ইতিহাস অতি প্রাচীন।১৬১০ সালে ঢাকায় মোগলদের শাসন পাকাপোক্ত হওয়ার পর বাগানের অনুরাগী মোগলরা এ উদ্যান তৈরি করেছিলেন। তখন এর নাম ছিল বাগ-ই-বাদশাহি।কিন্তু পরবর্তীতে কোম্পানী আমলে এ এলাকা জঙ্গলে পরিণত হয়।পরবর্তিতে ১৮২৫ সাল থেকে ব্রিটিশ কালেক্টর ডাউইজের সময় ঢাকা নগর উন্নয়নের অংশ হিসেবে রমনাপার্কের সংস্কার করে।তখন 'রমনা গ্রিন' নাম দিয়ে যাত্রা শুরু করে আজকের রমনা পার্ক। তখন এই পার্কের আয়তন ছিল প্রায় ৮৯ একর।সময়ের সঙ্গে ঢাকার অনেক রূপান্তর ঘটেছে।বদলে গেছে অনেক কিছু।ক্ষয় হতে হতে ঢাকা শহরের অনেক ঐতিহ্যই আর নেই তার আগের রূপে।তবে অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে রমনা।রমনার বর্তমান আয়তন ৬৮ দশমিক ৫ একর।পার্কের ভিতর থাকা লেকের আয়তন ৮ দশমিক ৭৬ একর।

ঢাকার ফুসফুস খ্যাত রমনাপার্কের ঐতিহাসিক মর্যাদার কথা বাদ দিলেও প্রকৃতি প্রেমী মানুষের কাছে এই পার্কের আবেদনই আলাদা।তাই তো শরীর সচেতন ও প্রকৃতি প্রেমীদের মিছিলে রোজ সকালেই নতুন মুখ যোগ হয়।এককোলে জগিং যদিও বাংলাদেশে বয়স্ক ও শারীরিক সমস্যায় আক্রান্তদের কাজ মনে করা হতো,একালে সেই ভুল ভেঙে গেছে।আর রমনাপার্ক হয়ে উঠেছে সেই শরীর সচেতন প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে স্বর্গ।তাই আমার মতোদের কাছে আধুনিক জিমের চেয়ে রমনাপার্ক পছন্দের জায়গা।

উদ্ভিদ প্রজাতি:
রমনা পার্কে বর্তমানে উদ্ভিদ প্রজাতি ২১১টি। এর মধ্যে ফুল ও  শোভাবর্ধক প্রজাতির সংখ্যা ৮৭টি, ফলজাতীয় উদ্ভিদ ৩৬টি, ঔষধি প্রজাতি ৩৩টি, কৃষি বনায়নের উদ্ভিদ প্রজাতি ৩টি, বনজ উদ্ভিদ প্রজাতি ২টি, জলজ উদ্ভিদ প্রজাতি ২টি ও মশলা উদ্ভিদ প্রজাতি ৩টি।এছাড়া অন্যান্য বর্ষজীবী ও বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ আছে।

বিরল প্রজাতির গাছ:

বৃক্ষের নানা বৈচিত্রময় প্রজাতিও লালন করে আসছে উদ্যানটি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিরলপ্রজাতির হলো-মহুয়াগাছ,পাদাঊক গাছ,রেইনট্রি,পলাশ, কাউয়াতুতি (বনপারুল), আগর, জ্যাকারান্ডা, তমাল, বাওবাব, গি¬রিসিডিয়া, কর্পূর, স্কারলেট কর্ডিয়া, জহুরিচাঁপা, ক্যাশিয়া জাভানিকা, মাধবী, মালতী, কেয়া, ছাতিম, কদম,আফ্রিকান টিউলিপ, কেয়া, অশোক, ট্যাবেবুয়া, নাগলিঙ্গম, কনকচূড়া, জারুল,সোনালু, আমাজন লিলি,পাখি ফুল, কফি, উদয়পদ্ম, সহস্রবেলী, গোল্ডেন শাওয়ার, পালাম, কাউফল, ঝুমকো, লতা পারুল, স্থলপদ্ম, কুর্চি, বন আসরা, চন্দন, মাকড়িশাল,দুলিচাঁপা, রসুন লতা, দেবকাঞ্চন,ধাইরা,কনকচাঁপা ইত্যাদি।


         




























একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ads Inside every post